ঢাকা, শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫, ৮ ভাদ্র ১৪৩২

শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যের নতুন ফাঁদ: ‘ডিটেনশন’

ডুয়া নিউজ- শিক্ষা
২০২৫ আগস্ট ২৩ ০৮:৪৭:৩২
শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যের নতুন ফাঁদ: ‘ডিটেনশন’

রাজধানীর কয়েকটি নামকরা স্কুলে শিক্ষার্থীদের ওপর নতুন এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে ‘ডিটেনশন’ নামক শাস্তির মাধ্যমে। হোমওয়ার্ক না করা বা ক্লাসে আশানুরূপ ফল না করার অজুহাতে শিক্ষার্থীদের ছুটির পরেও ১৫ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা পর্যন্ত জোর করে আটকে রাখা হচ্ছে। এমন অভিযোগও উঠেছে, যেসব শিক্ষার্থী শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট বা কোচিং পড়ছে না, মূলত তাদেরকেই এই শাস্তির শিকার হতে হচ্ছে।

শিক্ষক ও অভিভাবকদের মতে, এই ধরনের শাস্তি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক মানসিক চাপ তৈরি করছে। এতে তাদের মধ্যে স্কুলভীতি, হতাশা এবং এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে। এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে অভিভাবকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, স্কুলের উচিত পড়ালেখায় দুর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে গঠনমূলক উপায়ে তাদের সাহায্য করা, শাস্তি দেওয়া নয়।

শহরের পাঁচটি স্কুলের অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানিয়েছেন, আগে কোচিং না করলে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কম নম্বর দেওয়া বা খারাপ আচরণ করা হতো। এখন নতুন কৌশল হিসেবে ডিটেনশনকে শাস্তির হাতিয়ার বানানো হয়েছে। এর মাধ্যমে কোচিংয়ে না যাওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে।

অভিভাবকরা জানান, ছুটি শেষে কোচিং করা শিক্ষার্থীরা বাড়ি ফিরে গেলেও ডিটেনশনে থাকা শিক্ষার্থীরা আধা ঘণ্টা পর্যন্ত আটক থাকছে। এ সময় তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়, যার ফলে অনেকেই স্কুলবিমুখ হয়ে পড়ছে। জানা গেছে, এর নেপথ্যে কিছু প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষও জড়িত, যারা শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্যের টাকার ভাগ নিচ্ছেন।

গত ২১ জুলাই উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে সেখানে ৩৪ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ২৭ জন ছিলেন শিক্ষার্থী। তদন্তে জানা গেছে, সেদিন ছুটি শেষে ৪০ জন শিক্ষার্থীকে ডিটেনশনে আটকে রাখা হয়েছিল। এদের মধ্যে দুই ভাইবোন—ষষ্ঠ শ্রেণির নাজিয়া ও তৃতীয় শ্রেণির নাফি দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। নাজিয়া হোমওয়ার্ক না করায় ডিটেনশনে ছিল, আর ছোট ভাই নাফি বোনকে আনতে গিয়ে আগুনে পুড়ে যায়।

তাদের বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আশরাফুল ইসলাম বলেন, “সরকারি চাকরি শেষে আমার একমাত্র সম্পদ ছিল এই দুই সন্তান। একসঙ্গে দুজনকে হারিয়ে আমরা বেঁচে থাকব কীভাবে?”

সম্প্রতি মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজেও এমন ঘটনা ঘটে। ষষ্ঠ শ্রেণির এক সেকশনে ক্লাস শেষে ১৫ জন শিক্ষার্থী বাইরে আসতে দেরি করায় অভিভাবকরা উৎকণ্ঠায় পড়েন। পরে জানা যায়, তাদের ডিটেনশনে আটকে রাখা হয়েছিল। অঙ্কের এক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে কোচিং করার চাপ সৃষ্টি করছিলেন। কোচিংয়ে না যাওয়ায় ওই ১৫ জনকে ডিটেনশনে আটকে রেখে মানসিক নির্যাতন করা হয়।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, মূলত ডিটেনশন শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বা আচরণগত সমস্যার সমাধানের জন্য রাখা যেতে পারে। কিন্তু তা মানসিক নির্যাতনের হাতিয়ার হলে তা অপরাধ। তাদের মতে, কোচিং বাণিজ্যই এর মূল কারণ। ক্লাসরুমে পড়াশোনা যথাযথভাবে না করে শিক্ষকরা বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করার কাজটি কোচিংয়ে করছেন।

গণসাক্ষরতা অভিযানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এর মধ্যে ৪ কোটি ২৪ লাখ শিক্ষার্থী কোনো না কোনোভাবে স্কুলের বাইরে কোচিং নিচ্ছে—যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৭৭ শতাংশ। প্রতিবছর কোচিং সেন্টারগুলো থেকে আয় হচ্ছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানেও এর সত্যতা মিলেছে।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত