ঢাকা, শনিবার, ২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

ভয়াবহ সংকটের মুখে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প

ডুয়া নিউজ- জাতীয়
২০২৫ আগস্ট ০২ ২১:৩৫:০৭
ভয়াবহ সংকটের মুখে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প

বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প এক ভয়াবহ সংকটের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে দুই বছরের বেশি সময় ধরে আটকে আছে প্রায় এক হাজার নতুন ওষুধের নিবন্ধন, অন্যদিকে মাত্র তিন মাস পরেই ঘনিয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব আইন ‘ট্রিপস’-এর কঠোর শর্ত মেনে চলার বাধ্যবাধকতা। এই সময়ের মধ্যে ওষুধগুলো নিবন্ধন না পেলে দেশের বাজারে নতুন ওষুধ আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং পেটেন্ট বা রয়্যালটির কারণে ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।

শনিবার (২ আগস্ট) বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতি ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এই অশনিসংকেত তুলে ধরা হয়।

সভায় মূল বক্তব্যে ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, "আমরা ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হচ্ছি, কিন্তু ২০২৫ সালের নভেম্বর থেকেই নতুন ওষুধের ক্ষেত্রে আমাদের ট্রিপসের পূর্ণ শর্ত মানতে হবে। এর অর্থ, তখন নিবন্ধন ছাড়া কোনো নতুন ওষুধ আনা যাবে না, আর আনলেও উচ্চ হারে রয়্যালটি বা ব্যয়বহুল পেটেন্ট নিতে হবে।"

তিনি জানান, এই মুহূর্তে অন্তত এক হাজার নতুন ও জরুরি ওষুধ অনুমোদনের অপেক্ষায় অধিদপ্তরে পড়ে আছে। সরকারের কাছে তাদের জোরালো দাবি, ট্রিপসের শর্ত কার্যকর হওয়ার আগেই যেন এই সবগুলো ওষুধের নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়। অন্যথায়, এতদিন স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে ওষুধ উৎপাদন ও রপ্তানিতে যে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা বাংলাদেশ পেত, তা চিরতরে হারিয়ে যাবে।

রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ কায়সার কবির এই সংকটকে আরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "এই ঝুঁকি শুধু ওষুধ শিল্পের নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও বিপজ্জনক। এলডিসি হিসেবে আমরা ট্রিপসের ছাড়, স্বল্প সুদের ঋণসহ নানা সুবিধা পেয়ে এসেছি।" তিনি সেনেগাল বা কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোর উদাহরণ দিয়ে বলেন, "এখনো সময় আছে, অন্তত ৩ থেকে ৪ বছরের জন্য উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রক্রিয়াটি পিছিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।"

এই সংকটের পেছনে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও স্পষ্ট। ২০০৭ সালে সরকার ওষুধের কাঁচামাল বা ‘অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট’ (এপিআই) উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে গজারিয়ায় ২০০ একর জমিতে শিল্পপার্কের উদ্যোগ নিলেও গত ১৭ বছরে সেখানে কারখানা চালু করতে পেরেছে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান। অবকাঠামোগত অভাব, ছোট প্লট এবং গ্যাস সংযোগ না থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে জানান ডা. জাকির হোসেন।

ইউনিমেড ইউনিহেলথের চেয়ারম্যান এম মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে, যা এই খাতের বিশাল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। তিনি বলেন, "যেখানে ফিলিপাইনের মতো দেশ ৭৩ শতাংশ ওষুধ আমদানি করে, সেখানে বাংলাদেশ ৯৮ শতাংশ ওষুধ নিজেই তৈরি করে। আমাদের সক্ষমতা প্রশ্নাতীত।" কিন্তু ট্রিপস চুক্তির ঘন মেঘ এই উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে ঢেকে দিচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বক্তারা একসুরে বলেন, এই মুহূর্তে সরকারের সামনে দুটি জরুরি কাজ। প্রথমত, আগামী নভেম্বরের মধ্যে আটকে থাকা সব ওষুধের নিবন্ধন দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, ট্রিপসের বাধা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জোরালো লবিং চালানো। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হলে দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় এই রপ্তানি খাতটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার ওপর।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত