ঢাকা, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৮ ভাদ্র ১৪৩২

সরকারের সিদ্ধান্তে ডুবছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের স্বপ্ন?

আবদুস সাত্তার মিয়াজী
আবদুস সাত্তার মিয়াজী

সম্পাদক

২০২৫ সেপ্টেম্বর ১২ ১৫:৪৬:০২

সরকারের সিদ্ধান্তে ডুবছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের স্বপ্ন?

আবদুস সাত্তার মিয়াজী: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূত হয়ে একটি বড়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষিত থাকবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভণর ও অর্থ উপদেষ্টা বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন। এর ফলে ব্যাংকগুলোর আমানতকারীরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও, এসব ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অজানা ও অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় লাখো বিনিয়োগকারী আজ গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাদের চোখের জল আর নীরব জিজ্ঞাসা এক কঠিন বাস্তবতাকে সামনে এনেছে: শেয়ারবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কি তবে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে?

অন্ধকারের পথে বিনিয়োগকারীরা?

বর্তমান পরিস্থিতিতে, এই পাঁচ ব্যাংকের ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার ২ থেকে ৫ টাকায় নেমে এসেছে, যা হাজার হাজার বিনিয়োগকারীকে মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলেছে। বিশেষ করে যারা ১০ টাকা বেশি অনেক উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনেছিলেন, তাদের নিঃস্ব হওয়ার ধাক্কা অনেক বেশি। তাদের সঞ্চয়ের বড় অংশ এরই মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

বিনিয়োগকারীদের মতে, "আমরা সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিলাম, অথচ কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি আমাদের ভুল তথ্য দিয়ে প্রলুব্ধ করেছিলেন। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সঞ্চয়পত্র বা সুদ-ভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের চেয়ে কিছুটা বেশি উপার্জনের চেষ্টা করা। কিন্তু সেই অর্থ পুঁজিবাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে চলে গেছে।" তারা আরও বলেন, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বা নীতি নির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। অথচ, সেই দুর্নীতির মাশুল আজ তাদেরই দিতে হচ্ছে।

দেশের বাইরে থাকা অনেক প্রবাসীও তাদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের একাংশ এই ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করেছিলেন। সুদ পরিহার করে শেয়ারবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করা হলেও, শেয়ারমূল্যের এই পতন তাদেরও বড় আঘাত দিয়েছে। এটি শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির বিষয় নয়; এর ফলে প্রবাসীদের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে রেমিট্যান্স প্রবাহকেও প্রভাবিত করতে পারে।

প্রশ্নবিদ্ধ স্বচ্ছতা ও তথ্যের ঘাটতি

সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা নিরীক্ষকদের ত্রৈমাসিক এবং বার্ষিক প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করেই বিনিয়োগ করেছিলেন। তারা কখনও ব্যাংকের অভ্যন্তরের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা জানতেন না। দুর্নীতি যেহেতু শুধুমাত্র পরিচালক বা ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী গুটিকয়েক ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো দায় নেই। এই প্রেক্ষাপটে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নীরবতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়ে তুলছে।

বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ থাকলেও, শেয়ারহোল্ডারদের জন্য এটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে যাবে। এই পরিস্থিতি আবারও প্রমাণ করে যে, সৎ ও ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে। এটি শেয়ারবাজারে আরও বেশি স্বচ্ছতা এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করে তুলেছে।

ভবিষ্যৎ প্রভাব ও করণীয়

দেশের শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও, সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দৃঢ় পদক্ষেপ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে। এটি শুধু মুখের কথা নয়, বরং বাস্তব নীতি ও উদ্যোগে তা প্রতিফলিত হচ্ছে। পাঁচ দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার যে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুরো আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার সরকারের সদিচ্ছারই প্রতিফলন। এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, সরকার এখন আর ছোটখাটো সমস্যায় আটকে থাকতে চায় না, বরং বড় ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনীতির মূল ভিত্তি শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সংকটময় মুহূর্তে সরকারের এই দৃঢ়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, বাজারের প্রতিটি অংশ, বিশেষ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে। আমানতকারীদের মতো শেয়ারহোল্ডারদেরও সুরক্ষা দেওয়া হবে, যাতে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ কোনো দুর্নীতিবাজের হাতে নষ্ট না হয়। এই লক্ষ্যে, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করবে, যা এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত শেয়ারহোল্ডারদের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করবে। এটি বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনবে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার পথ সুগম করবে।

সরকারের এই প্রত্যয় কেবল নীতিগত সিদ্ধান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি নতুন যুগের সূচনা। যেখানে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা হবে, কারসাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং প্রতিটি বিনিয়োগের আগে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ তৈরি হবে। এই উদ্যোগের ফলে, ভবিষ্যতে কোনো বিনিয়োগকারীকে অন্ধকারে রেখে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না, বরং প্রতিটি পদক্ষেপ হবে স্বচ্ছ এবং সবার জন্য সমান। এটি শুধু একটি সংকট সমাধান নয়, বরং পুরো শেয়ারবাজারকে একটি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনার অংশ।

পরিশেষে, বলা যায়, সরকারের এই সদিচ্ছা এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতি দায়বদ্ধতা শেয়ারবাজারের ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করবে। যখন বিনিয়োগকারীরা দেখবেন যে তাদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার সক্রিয় এবং কোনো অনিয়মকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না, তখন তারা নির্ভয়ে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবেন। এটি শুধুমাত্র শেয়ারবাজারের উন্নয়নে নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও এক নতুন গতি সঞ্চার করবে।

এএসএম/

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

সর্বোচ্চ পঠিত