ঢাকা, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫, ২০ আশ্বিন ১৪৩২

বেস্ট হোল্ডিংসের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি উন্মোচন!

২০২৫ অক্টোবর ০৫ ০৬:৪৩:০১

বেস্ট হোল্ডিংসের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি উন্মোচন!

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের শেয়ারবাজারে যেন এক অভূতপূর্ব আর্থিক নাটকের জন্ম দিয়েছে লা মেরিডিয়ান হোটেলের মালিকানাধীন বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড। কাগজে-কলমে সাজানো লাভের গল্পে বিনিয়োগকারীদের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক ও শেয়ারবাজার—দুই খাত থেকেই প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। ভুয়া জমির দলিল, জাল নিরীক্ষা প্রতিবেদন, অতিমূল্যায়িত সম্পদ ও কৃত্রিম বিনিয়োগ কাঠামোর মাধ্যমে বোনা এই প্রতারণা এখন ‘চামচা পুঁজিবাদ’-এর সবচেয়ে ভয়ংকর দৃষ্টান্ত। এর নেপথ্যের কারিগর, বিতর্কিত ব্যবসায়ী আমিন আহমেদ টাকা পাচারের অভিযোগে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর গঠিত বিএসইসি’র তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, শাসকগোষ্ঠীর আশ্রয়ে গড়ে ওঠা অশুভ যোগসাজশে (Unholy Nexus) আর্থিক খাতকে পঙ্গু করে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল বেস্ট হোল্ডিংস।

তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে—বেস্ট হোল্ডিংস ইচ্ছাকৃতভাবে জমির ভুয়া দলিল তৈরি করে সম্পদের মূল্য বাড়িয়ে দেখিয়েছে। এক পর্যায়ে ৪,০৮১ কোটি টাকার জমি কোম্পানির নামে দেখানো হলেও এর প্রকৃত মালিকানা নেই। এই জাল কাগজের ওপর নির্ভর করে সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংক ও আইসিবি—এই পাঁচ সরকারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে ১,৯৬৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৯০০ কোটিরও বেশি ক্ষতি ইতিমধ্যেই নিশ্চিত হয়েছে। শুধু সোনালী ব্যাংকের ক্ষতি ৪২৩ কোটি টাকা—যা জনগণের আমানতের অর্থ।

তদন্তে বলা হয়, এই জালিয়াতির অর্থের বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বিএসইসি-কে দ্রুত স্বাধীন ফরেনসিক অডিট করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং বিষয়টি দুদকে পাঠানোর সুপারিশও করা হয়েছে।

২০১৭ সাল থেকে অনিয়মের শুরু। সে সময় বিএসইসি’র চেয়ারম্যান ছিলেন ড. খায়রুল হোসেন। আইন লঙ্ঘন করে মাত্র ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমতি দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কমিশন এসে সেই অনিয়মের পথ আরও প্রশস্ত করে।

১০ টাকার শেয়ারের বিপরীতে ৫৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৬৫ টাকায় বিক্রির অনুমতি দেয় বিএসইসি—যা শুরু থেকেই সরকারি ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির কারণ হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বেস্ট হোল্ডিংসের এই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত আছেন সাবেক মন্ত্রী, সেনা কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগপন্থী ব্যবসায়ী মহল। তাঁদের প্রত্যেকেই আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে অনিয়মে সহায়তা করেছেন।

প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ আছে—শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন ও ডিজিএফআইর সাবেক মহাপরিচালক লে. জে. (অব.) মামুন খালেদ বেস্ট হোল্ডিংসের পরিচালক পদে ছিলেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে অযোগ্য ঘোষণা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছেন রেস ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. হাসান তাহের ইমাম। তাঁরা মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগ অর্থ বেস্ট হোল্ডিংসের শেয়ারে ঢুকিয়ে দেন—ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীর অর্থ বিপদে পড়ে।

রেসের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো—সেন্টিনেল ট্রাস্টি, গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, আর্গাস ক্রেডিট রেটিং, ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এক ভয়ংকর “কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট” চক্র, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থা জেনেও বন্ধ করেনি।

তদন্ত কমিটি আমিন আহমেদ ও হাসান আহমেদকে ১০ কোটি করে মোট ২০ কোটি টাকা জরিমানা,রেস ম্যানেজমেন্টকে ২৫ কোটি টাকা জরিমানা ও নিবন্ধন বাতিল, নাফিজ সরাফাত ও হাসান তাহের ইমামকে আজীবনের জন্য শেয়ারবাজারে নিষিদ্ধ, বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন ও শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে আজীবন নিষিদ্ধ, এবং তাঁদের কমিশনারদের বিরুদ্ধে দুদকে তদন্ত পাঠানোর সুপারিশ করেছে।

একই সঙ্গে মিউচুয়াল ফান্ডের ১০টি নিবন্ধন বাতিল, আইসিবি ও বিজিআইসি-কে জরিমানা, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ও অডিট ফার্মগুলোর লাইসেন্স স্থগিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে রিপোর্টটি প্রকাশের পরও ১০ মাস ধরে রিপোর্টটি গোপন রাখা হয়েছে।

এএসএম/

শেয়ারবাজারের বিশ্লেষণ ও ইনসাইড স্টোরি পেতে আমাদের পেজ ফলো করুন।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

নন-লিস্টেড বন্ড-ডিবেঞ্চারে বিনিয়োগও ঋণ হিসেবে গণ্য হবে

নন-লিস্টেড বন্ড-ডিবেঞ্চারে বিনিয়োগও ঋণ হিসেবে গণ্য হবে

হাসান মাহমুদ ফারাবী: বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে (এনবিএফআইএস) তাদের নন-লিস্টেড সিকিউরিটিজে করা বিনিয়োগ—যেমন নন-কনভার্টিবল কিউমুলেটিভ প্রেফারেন্স... বিস্তারিত