ঢাকা, বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২ পৌষ ১৪৩২

শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের খালি হাতে ফেরালো ৫৭ কোম্পানি

২০২৫ ডিসেম্বর ১৭ ০০:১০:২১

শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের খালি হাতে ফেরালো ৫৭ কোম্পানি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতি এবং লোকসানের কারণে বিতরণযোগ্য তহবিলের অভাবে দেশের শেয়ারবাজার তালিকাভুক্ত অন্তত ৫৭টি কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কোনো ডিভিডেন্ড দেবে না, যার ফলে এক বছর অপেক্ষার পর বিনিয়োগকারীরা শূন্য হাতে ফিরছেন।

ডিএসই'র তথ্য অনুযায়ী, বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড না দেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এবং বাকি ৫২টি কোম্পানি উৎপাদন খাতের অন্তর্ভুক্ত। ২০২৪-২৫ অর্থবছররের জন্য প্রায় ২০০টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি তাদের বার্ষিক আর্থিক ফলাফল ঘোষণা করেছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুই ডজন সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির মধ্যে ১২টি ডিভিডেন্ডের সুপারিশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, বস্ত্র খাতের মোট ৫৮টি কোম্পানির মধ্যে ১৩টি কোম্পানি তাদের শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি।

এছাড়াও, ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের ৯টি কোম্পানি, ওষুধ খাতের পাঁচটি, ব্যাংক ও এনবিএফআই খাতের (২০২৪ সালের জন্য) পাঁচটি, বিদ্যুৎ, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক এবং তথ্য ও প্রযুক্তি খাতের ৯টি এবং ট্যানারি, সিমেন্ট ও কাগজ খাতের পাঁচটি কোম্পানি শূন্য ডিভিডেন্ডের সুপারিশ করেছে।

এর পাশাপাশি, ৪৩টি কোম্পানি কেবল সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে, যার অর্থ হলো— কোম্পানির স্পন্সর-পরিচালকরা বিতরণযোগ্য মুনাফা থেকে কোনো ডিভিডেন্ড পাবেন না। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কিছু কোম্পানি 'জেড' ক্যাটাগরিতে অবনমন এড়াতে ১ শতাংশেরও কম নামমাত্র ডিভিডেন্ডের সুপারিশ করেছে।

বিশ্লেষক এবং শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক বছর ধরে দুর্বল সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ব্যবসার পারফরম্যান্সের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ও ইউটিলিটি খরচ, সেই সঙ্গে কাঁচামালের সংকট অনেক কোম্পানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলস্বরূপ, বহু কোম্পানি মুনাফা করতে ব্যর্থ হয়েছে, বেশিরভাগের আয় সংকুচিত হয়েছে, এবং কিছু কোম্পানি বড় লোকসানে পড়েছে। নেতিবাচক সংরক্ষিত আয়ের কারণে এসব কোম্পানি ডিভিডেন্ড দিতে পারেনি।

ডিভিডেন্ড প্রদানে সরকারি কোম্পানিগুলো শীর্ষে

বিদ্যুৎ, এনবিএফআই, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং খাদ্য ও সহযোগী খাত থেকে তালিকাভুক্ত প্রায় এক ডজন সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি রয়েছে। তিন বছর আগেও বেশিরভাগ সরকারি কোম্পানি লাভজনক ছিল এবং শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দিত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি প্রায় উল্টে গেছে। বেসরকারি খাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওঠানামার মতো বাহ্যিক কারণগুলোর জন্য বেশিরভাগ কোম্পানিই ব্যাপক লোকসানে ডুবেছে। তথ্য অনুযায়ী, ১২টি কোম্পানি ব্যাপক লোকসানের কারণে ডিভিডেন্ড দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে।

ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) টানা দুই অর্থবছর শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লোকসান বেড়ে যাওয়া এবং নেতিবাচক সংরক্ষিত আয়ের কারণে ২০০৬ সালে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর এই প্রথম কোম্পানিটি 'জেড' ক্যাটাগরিতে নেমে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডেসকো ১২৫ কোটি টাকা লোকসান করেছে এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত এর মোট লোকসান ১ হাজার ১৭২ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) তার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডিভিডেন্ড প্রদান থেকে বিরত থেকেছে। দুর্বল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত এবং শেয়ারবাজারের মন্দার ফলে অর্থবছর ২০২৫-এ তারা ১,২১৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে। পূর্বে উচ্চ মুনাফা করে তারা ১০ শতাংশের বেশি নগদ ডিভিডেন্ড দিলেও, অর্থবছর ২০২৪-এর জন্য তারা মাত্র ২ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল।

আরেকটি সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য কোনো ডিভিডেন্ড দেবে না বলে ঘোষণা করেছে। এটি টানা দ্বিতীয় বছর ডিভিডেন্ড দেওয়া থেকে বিরত থাকল। পূর্বে এই কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের আকর্ষণীয় ডিভিডেন্ড দিত।

ডিভিডেন্ড না দেওয়া অন্যান্য সরকারি কোম্পানিগুলো হলো— বাংলাদেশ সার্ভিসেস (ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের পরিচালনাকারী), ন্যাশনাল টি, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর (বিডি), শ্যামপুর সুগার মিলস, উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি, জিল বাংলা সুগার মিলস, অ্যাটলাস বাংলাদেশ, ইস্টার্ন কেবলস এবং আজিজ পাইপস।

১৩টি বস্ত্র খাতের কোম্পানির শুন্য ডিভিডেন্ড

তথ্য অনুযায়ী, বস্ত্র খাতের ১৩টি কোম্পানি অর্থবছর ২০২৫-এর জন্য তাদের শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দেওয়া থেকে বিরত রয়েছে। এই কোম্পানিগুলো ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়ায় এবং মুনাফা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় শূন্য ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে।

ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস অর্থবছর ২০২৫-এ সর্বোচ্চ ২২৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে। গত তিন বছরে কোম্পানিটির মোট লোকসান দাঁড়িয়েছে ৪০৬ কোটি টাকা। লোকসান বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটি ডিভিডেন্ড দিতে পারেনি। তাদের সর্বশেষ ডিভিডেন্ড ছিল ২০২২ সালের জুনে সমাপ্ত বছরের জন্য ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড।

কাগজ শিল্পের অন্যতম প্রধান কোম্পানি বসুন্ধরা পেপার মিলসও কাঁচামালের সংকট ও ঋণের ভারে ব্যবসা খারাপ হওয়ায় ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬৬ কোটি টাকা রেকর্ড লোকসান দেখিয়ে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। লোকসানের কারণে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর এই প্রথম তারা ডিভিডেন্ড সুপারিশ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এএসএম/

শেয়ারবাজারের বিশ্লেষণ ও ইনসাইড স্টোরি পেতে আমাদের পেজ ফলো করুন।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

শেয়ারবাজার এর অন্যান্য সংবাদ