ঢাকা, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫, ২৪ আশ্বিন ১৪৩২

শিশুর দুষ্টুমি নিয়ে বিরক্ত, অজান্তেই আপনি দায়ী নন তো?

সরকার ফারাবী
সরকার ফারাবী

সিনিয়র রিপোর্টার

২০২৫ অক্টোবর ০৭ ১৬:১৬:১০

শিশুর দুষ্টুমি নিয়ে বিরক্ত, অজান্তেই আপনি দায়ী নন তো?

লাইফস্টাইল ডেস্ক: আমার সন্তান খুব দুষ্টু, না মারা পর্যন্ত কথা শোনে না এমন কথা অনেক বাবা-মায়ের মুখে শোনা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সন্তানের গায়ে হাত তোলা কি সত্যিই কোনো সমাধান?

শিশু যদি খুব চঞ্চল হয়, একবার বলা কথা না শোনে বা বারবার দুষ্টুমি করে, তখন অনেক অভিভাবক রাগের মাথায় তাকে শাসন করতে গিয়ে মারধর করে ফেলেন। হয়তো ওই মুহূর্তে শিশুটি শান্ত হয়ে যায়, কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার আগের আচরণে ফিরে আসে।

আসলে শিশুটি জন্ম থেকেই এমন নয়। তার মানসিক ও সামাজিক বিকাশ ধীরে ধীরে ঘটে। যেমন হামাগুড়ি দেওয়া বয়সে সে বুঝতে পারে না যে মেঝেতে থাকা কিছু খাওয়া ঠিক নয়, তেমনি জানে না কীভাবে তার চাহিদা প্রকাশ করতে হয় বা মন খারাপের অনুভূতি সামলাতে হয়। এসব তাকে সময় নিয়ে শেখাতে হয় ভালোবাসা, ধৈর্য আর সহানুভূতির মাধ্যমে।

অভিভাবকের আচরণই গড়ে দেয় শিশুর ব্যক্তিত্ব। তাই যখন সে ভুল কিছু করে, তখন তাকে না বুঝে মারলে তা শিশুর মানসিক বিকাশে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। শাসনের নামে শারীরিক আঘাত সন্তানের মনে ভয়, ক্ষোভ ও অপরাধবোধ তৈরি করে যা সম্পর্ককেও দূরত্বে ঠেলে দেয়।

এই বিষয়টি বোঝাতে অনেকেই ধূমপানের সঙ্গে তুলনা করেন। কেউ যদি কখনো ধূমপান না করে, তার আসক্ত হওয়ার ঝুঁকি নেই। কিন্তু একবার চেষ্টা করলে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। একইভাবে, একবার শিশুর গায়ে হাত তুললে সেটি ধীরে ধীরে অভিভাবকের আচরণের অংশ হয়ে যেতে পারে। ফলাফল শিশুর মধ্যে ভয়, আত্মবিশ্বাসহীনতা ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সন্তানকে বড় করার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো জেন্টল প্যারেন্টিং। এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয় অভিভাবকের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও শিশুর আবেগ বোঝার ক্ষমতার ওপর। এই পদ্ধতিতে শিশুর ভুল আচরণকে শুধু শাস্তি নয়, বরং শেখানোর সুযোগ হিসেবে দেখা হয়।

মনোবিজ্ঞানে প্যারেন্টিংয়ের চারটি ধারা রয়েছে—

নেগলেক্টফুল, পারমিসিভ, অথোরিটেরিয়ান এবং অথোরিটেটিভ (বা জেন্টল)।

* উদাহরণ হিসেবে ধরুন একটি শিশু টেবিলের ওপর রাখা পানির বোতল ছুড়ে ফেলেছে।

* পারমিসিভ অভিভাবক বলবেন, এমন কোরো না প্লিজ।

* নেগলেক্টফুল অভিভাবক দেখেও চুপ থাকবেন।

* অথোরিটেরিয়ান অভিভাবক চিৎকার করবেন, শাস্তি দেবেন বা মারতে পারেন।

আর জেন্টল অভিভাবক বলবেন, তুমি হয়তো খেলতে চাও, কিন্তু বোতল ফেললে আমরা পানি খাব কীভাবে? চল, বল দিয়ে খেলি।

এভাবেই ভালোবাসা ও যুক্তির মাধ্যমে শিশুকে সীমা শেখানো যায়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচিত জেন্টল প্যারেন্টিং আসলে আধুনিক অথোরিটেটিভ পদ্ধতিরই রূপ। এর উদ্দেশ্য হলো শিশুকে আবেগ নিয়ন্ত্রণ শেখানো এবং ভুল করলে যুক্তিসঙ্গত পরিণতি বুঝতে সাহায্য করা।

যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. ব্রায়ান রাজ্জিনো বলেন—

জেন্টল প্যারেন্টিং মানে শুধু আদরে বড় করা নয়, বরং এটি সন্তানকে প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক দক্ষতা শেখানোর প্রক্রিয়া।

শিশুকে আলাদা ব্যক্তি হিসেবে দেখা, তার অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করা এবং ধৈর্য ধরে তাকে শেখানো এই মনোভাবই শিশুর মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে। সেই আস্থাই তাকে আত্মবিশ্বাসী, সহানুভূতিশীল ও মানসিকভাবে স্থিতিশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।

তবে এই পদ্ধতি সহজ নয়, বিশেষ করে যারা নিজেদের শৈশবে সহানুভূতি পাননি বা শাসন মানে মারধর ভেবে বড় হয়েছেন। তাদের জন্য ধৈর্য ধরে আবেগ নিয়ন্ত্রণ শেখা কঠিন হতে পারে, কিন্তু নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে এটি সম্ভব।

ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট থমাসের মনোবিজ্ঞানী ড. এনি পেজালো বলেন, শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য চারটি উপাদান সবচেয়ে জরুরি—

১. স্পষ্ট কাঠামো ও নিয়ম২. ভালোবাসা ও উষ্ণতা৩. শিশুকে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে দেখা৪. দীর্ঘমেয়াদি ধৈর্য ধরে লালন-পালন করা

অভিভাবক নিখুঁত হতে হবে এমন নয়। বরং সন্তানের সামনে ভুল স্বীকার করা, ক্ষমা চাওয়া এবং ভালোবাসায় সংশোধন করা এসবই তাকে শেখায় কীভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সীমা মানতে হয় এবং মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে হয়।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত