ঢাকা, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২
ছাত্রলীগমুক্ত প্রথম ক্যাম্পাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

জুলাই বিপ্লবের সময় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। সেই আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠন তৎপরবর্তী সময়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা নেয়। তারা হুমকি-ধামকি, ভয়ভীতি ও সরাসরি হামলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।
তবে শিক্ষার্থীরা দ্রুত বুঝে ফেলেছিল, আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে হলে ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে সরাতে হবে। এই উপলব্ধি থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথম পদক্ষেপ নেয়।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বিকেল তিনটার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক-সহ পুরো ইউনিটকে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করে। এর মধ্য দিয়ে রাবি হয়ে ওঠে প্রথম ছাত্রলীগমুক্ত ক্যাম্পাস।
আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাবেক সমন্বয়কারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নতুন গতি আসে ওই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। ঐদিন শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল বেলা আড়াইটায়, কিন্তু ছাত্রলীগ একই স্থানে এক ঘণ্টা আগে জমায়েতের ঘোষণা দেয় আন্দোলন ব্যাহত করতে। এর জবাবে কৌশল হিসেবে শিক্ষার্থীদের গোপনে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে বলা হয় এবং তারা নির্ধারিত সময়ের আগেই সংগঠিতভাবে বেরিয়ে আসে। এই পরিকল্পিত ও সংগঠিত পদক্ষেপই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বস্থানে নিয়ে আসে।
১৬ জুলাই আমরা সর্বপ্রথম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করি। এরপর ওইদিন রাতে ও পরদিন সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা হয়। মূলত ছাত্রলীগকে বের করার মাধ্যমেই ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান রচিত হয়। ইতোপূর্বে ফ্যাসিস্ট রেজিমের পেটোয়া বাহিনীকে আমরা ক্যাম্পাস থেকে বের করতে পারিনি এবং ছাত্রলীগই বারবার আমাদের আন্দোলনে মারপিট করে দমন করেছে, যা আমরা ২০১৮ সালেও দেখেছি। তাই আমি মনে করি, এই ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার মাধ্যমেই নতুন বাংলাদেশের শুভ সূচনা হয়েছে। (মেহেদী সজীব, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক)
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দুপুর আড়াইটায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুরের মন্ডলের মোড় থেকে দুই-আড়াইশ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি মিছিল শুরু হয়। এতে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন রাবি শিবিরের অফিস সম্পাদক ইমরান নাজির। শুরুতে সংখ্যাটি সীমিত থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যেই শত শত শিক্ষার্থী যোগ দেন তাদের সঙ্গে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় ফটকের সামনে অবস্থান করা প্রায় ১০০ পুলিশ সদস্য কোনো বাধা দেয়নি। মিছিলের অংশগ্রহণকারীদের হাতে ছিল রড, লাঠি ও পাইপ প্রতিরোধের প্রস্তুতি হিসেবে।
এই দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে হলগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা দলে দলে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। মিছিলটি জোহা চত্বর হয়ে প্যারিস রোডে গেলে বিপরীত দিক থেকে আরেকটি বড় দল এসে যুক্ত হয়। মেয়েদের হলের সামনে পৌঁছালে এক থেকে দেড় হাজারের মতো ছাত্রীও মিছিলে যোগ দেন।
বিক্ষোভকারীরা বিজ্ঞান ভবনের পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়ে হবিবুর রহমান হলের মাঠ ঘুরে শহীদ জিয়াউর রহমান হলের সামনে পৌঁছালে সেখানে অবস্থানরত ছাত্রলীগের সদস্যদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ শুরু হয়। ছাত্রলীগ সদস্যরা ইটপাটকেল ছুঁড়লেও শিক্ষার্থীরা তাদের পিছু হটিয়ে মাদার বখ্শ হলের সামনে পাঠিয়ে দেয়। একই সময়ে বিভিন্ন হল থেকে আরও মিছিল বেরিয়ে আসতে থাকে। শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ হিল গালিবকে শিক্ষার্থীরা ধাওয়া দিলে তিনি মোটরসাইকেল দিয়ে পালিয়ে যান। তার পালানোর একটি ১০ সেকেন্ডের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা এরপর গালিবের কক্ষও ভাঙচুর করেন।
পরবর্তী মিছিল গিয়ে পৌঁছায় বিজয় ২৪ হলের সামনে, যেখানে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কক্ষে অভিযান চালানো হয়। এই অভিযানে ছাত্রলীগ সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে পুলিশ উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দপ্তর কক্ষ-সহ বেশ কয়েকটি রুম থেকে শিক্ষার্থীরা উদ্ধার করে তিনটি পিস্তল, ছয়টি রামদা, ১০-১৫টি মদের বোতল, বেশ কয়েকটি ছুরি ও রড। উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও দ্রব্যাদি পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী ও সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মেশকাত চৌধুরী মিশু জানান, আন্দোলন নস্যাৎ করতে ছাত্রলীগ নানা কৌশলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কর্মসূচির স্থান দখল, হল গেটে তালা লাগানো এবং হলের সামনে নজরদারি চালানো সবই ছিল পরিকল্পনার অংশ। কিন্তু এসব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক এক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ১৬ জুলাইয়ের ঘটনাপ্রবাহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রলীগমুক্ত প্রথম ক্যাম্পাসে রূপান্তর করে এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এক নতুন মোড় সৃষ্টি করে।
১৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল। এই ঘটনার জন্য আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ১৫ তারিখ থেকেই। ছাত্রলীগের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় আমরা গোপনে সময় এগিয়ে এনে দুপুর আড়াইটায় আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের মিছিলের সংখ্যা এতটাই বড় ও শক্তিশালী ছিল যে, ছাত্রলীগ তখন ভয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে।(সানজিদা ঢালি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য)
তিনি আরো বলেন, ওইদিন আমি ছাত্রলীগের গতিবিধি লক্ষ্য করতে মাদার বখ্শ হলের সামনে আসি। দেখি ছাত্রলীগের সেক্রেটারি গালিব তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে বেঞ্চে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরেই কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর একটি বিক্ষোভ মিছিল আসাদুল্লাহ-হিল গালিব ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের তাড়া করে। এতে তারা আতঙ্কিত হয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। নিমেষেই তাদের দীর্ঘদিনের মসনদ ভেঙে খান খান হয়ে যায়। বিরল সে মাহেন্দ্রক্ষণ স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে ছাত্রলীগমুক্ত প্রথম ক্যাম্পাস।
আন্দোলনে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সানজিদা ঢালি। তিনি বলেন, ১৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল। এই ঘটনার জন্য আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ১৫ তারিখ থেকেই। যদিও আন্দোলনের সময় নির্ধারণ ছিল ১৬ জুলাই বিকাল ৩টা। তবে ছাত্রলীগের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় আমরা গোপনে সময় এগিয়ে এনে দুপুর আড়াইটায় আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নিই। মেয়েদের হলগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। সেই অনুযায়ী আমি ১৬ তারিখ দুপুর ১টা থেকেই মন্নুজান হলে ঘণ্টা বাজিয়ে ডাকাডাকি শুরু করি এবং আন্দোলনের জন্য মেয়েদের জড়ো করতে থাকি। পরে একত্রিত হয়ে আমরা অন্যান্য হলগুলোতেও যাই এবং স্লোগানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আহ্বান জানাতে থাকি।
তিনি আরও বলেন, সব হলের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে যখন মন্নুজান হলের সামনে অবস্থান নেয়, তখন দেখি ছেলেরা প্যারিস রোড হয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছে। আমরা মেয়েরা সেই মিছিলে যুক্ত হই এবং একসঙ্গে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করি। আমাদের মিছিলের সংখ্যা এতটাই বড় ও শক্তিশালী ছিল যে, ছাত্রলীগ তখন ভয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব বলেন, ১৬ জুলাই আমরা প্রথমবারের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে সরাতে সক্ষম হই। এরপর ওই রাতেই এবং পরদিন সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ অন্যান্য সব বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা হয়। মূলত, ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে হটানোর মধ্য দিয়েই ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের ভিত্তি রচিত হয়।
তিনি আরও বলেন, এর আগে আমরা কখনোই ফ্যাসিস্ট শাসকের দমন পীড়ন চালানো পেটোয়া বাহিনীকে ক্যাম্পাস থেকে সরাতে পারিনি। বারবার ছাত্রলীগ আমাদের আন্দোলনে বাধা দিয়েছে, দমন করেছে যার নজির আমরা ২০১৮ সালেও দেখেছি। তাই আমার বিশ্বাস, ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার মধ্য দিয়েই নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে।
পাঠকের মতামত:
সর্বোচ্চ পঠিত
- চলতি সপ্তাহে বেক্সিমকোর ফ্লোর প্রাইস ওঠার সম্ভাবনা
- অস্বাভাবিক শেয়ার দাম: ডিএসইর সতর্কবার্তার জালে তিন কোম্পানি
- শেয়ারবাজারে তানিয়া শারমিন ও মাহবুব মজুমদার ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ
- চ্যাটজিপিটি ব্যবহারে ভয়াবহ বিপদ, গবেষণায় উঠে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য
- শেয়ারের অস্বাভাবিক দামের জন্য ডিএসইর সতর্কবার্তা
- শেয়ারবাজারের ৩ প্রতিষ্ঠানের ২৯৬ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং
- শিক্ষার্থীদের আলোকিত ভবিষ্যত গড়তে পাশে থাকবে ঢাবি অ্যালামনাই
- ১০ লাখ শেয়ার কেনার ঘোষণা তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তার
- ঢাবির ২০১৮-১৯ সেশনের অছাত্ররা হতে পারবেন না ভোটার-প্রার্থী
- শোক সংবাদ পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পলক
- ডিভিডেন্ড পেয়েছে চার কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা
- ১৫ দিনে ১৭ প্রতিষ্ঠানে ২০ শতাংশের বেশি মুনাফা
- সর্বোচ্চ আগ্রহের তালিকায় ৪ খাতের শেয়ার
- বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ চাহিদার শীর্ষে ৭ কোম্পানি
- ১৬ জুলাই সরকারি ছুটি কি-না? যা জানা যাচ্ছে