ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২
শহীদ আবু বকরের অসমাপ্ত স্বপ্ন

রিয়াদুল ইসলাম, ঢাবি শিক্ষার্থী
ঢাকার শীতল রাত। ২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা মেডিকেলের করিডোরে একটা নিস্তব্ধতা, যেন এক অপূর্ণ কান্না জমাট বেঁধেছে বাতাসে। হাসপাতালের একটা কেবিনের বাইরে কয়েকজন যুবক-তরুণ বসে, কেউ কাঁদছে, কেউ চুপচাপ দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে আছে। ভিতরে শুয়ে আছে এক তরুণ, মাথার একপাশ রক্তে ভিজে গেছে, চেহারায় শান্তির ছাপ, যেন ঘুমিয়ে আছে। অথচ সে আর জাগবে না!
তার নাম আবু বকর সিদ্দিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের এক মেধাবী ছাত্র। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এই তরুণ ছেলেটি স্বপ্ন দেখেছিল বড় কিছু হওয়ার, কিন্তু সেই স্বপ্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়েছে এক দানবীয় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে—সন্ত্রাসী রাজনীতির নির্মম বলি হয়ে।
টাঙ্গাইলের মধুপুরের এক হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম আবু বকরের। বাবা রুস্তম আলী একজন দিনমজুর। তীব্র দারিদ্র্যের মাঝেও ছেলেকে পড়াশোনা করানোর স্বপ্ন দেখতেন মা-বাবা। আবু বকর ছোট থেকেই মেধাবী, একবার পড়লেই মুখস্থ হয়ে যেত সব। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকরা তাকে নিয়ে গর্ব করতেন। মাধ্যমিকে প্রথম, উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম, তারপর স্বপ্নপূরণের পথে প্রথম ধাপ—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি।
হলের ৪০৪ নম্বর কক্ষেই তার ঠিকানা। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করত, ছুটিতে বাড়ি গেলে কৃষিকাজেও বাবাকে সাহায্য করত। গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়াত, সবাইকে অনুপ্রেরণা দিত উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখতে। কিন্তু কেউ ভাবেনি, এত সুন্দর স্বপ্নগুলো এক রাতে ঝরে যাবে।
২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, স্যার এ এফ রহমান হলে উত্তেজনা। হলের দুই পক্ষের ছাত্রলীগ নেতা—সাইদুজ্জামান ফারুক ও মেহেদী হাসান মোল্লা—হলের নিয়ন্ত্রণ নিতে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রড, হকিস্টিক, লাঠি, স্ট্যাম্প, ধারালো অস্ত্র আর আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া চলে সারা হলজুড়ে। সাধারণ ছাত্ররা আতঙ্কে দরজা বন্ধ করে থাকে। কিন্তু আবু বকর তো রাজনীতি করত না, তাহলে কেন তার উপর আঘাত?
হল ছেয়ে যায় চিৎকারে। রডের আঘাতে ছাত্রদের মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। এমনই এক মুহূর্তে, দৌড়ে বেরোনোর চেষ্টা করছিল আবু বকর। ঠিক তখনই, হঠাৎ এক গুলির শব্দ!
কেউ জানে না কার ছোড়া গুলি, তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে, সাইদুজ্জামান ফারুকের হাতে থাকা বন্দুক থেকেই বের হয়েছিল সেই মৃত্যুবার্তা। বুলেট এসে আঘাত করল আবু বকরের মাথায়। ধপ করে পড়ে গেল সে। কয়েকজন বন্ধুর চিৎকারে কেঁপে উঠল হল।
তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। একদিন, দুইদিন... ৩ ফেব্রুয়ারির রাত এল। হাসপাতালের বিছানায় নিথর হয়ে পড়ে রইল আবু বকর, রক্তে ভিজে থাকা লুঙ্গির একমাত্র সাক্ষী হয়ে থাকল তার শেষ মুহূর্তের লড়াই।
ঘটনার পর মামলা হয়। একের পর এক তদন্ত কর্মকর্তা বদলানো হয়। পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়, আবু বকর পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলের আঘাতে মারা গেছে। অথচ প্রত্যক্ষদর্শী ১১ জন সাক্ষ্য দিলেন, তারা দেখেছেন গুলি লেগেছে। তারপরও বিচার হয়নি।
২০১৭ সালে আদালত সব আসামিকে খালাস দিল। আট মাস পর সেই রায়ের খবর পৌঁছাল শহীদ আবু বকরের মায়ের কাছে। তিনি শুধু বলেছিলেন, "আমার ছেলে হত্যার বিচার পাইলাম না, এইডা কেমন দেশ?" কেউ কোনো উত্তর দেয়নি। আবু বকরের নাম ধীরে ধীরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল থেকে, ছাত্রদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে লাগল।
২০২৫ সালে এসে নতুন শিক্ষার্থীরা জানতে পারে আবু বকরের গল্প। তারা দাবি তোলে—তার নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে হবে, প্রতি বছর শাহাদাত বার্ষিকী পালন করতে হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব। কিন্তু প্রশ্ন একটাই—এই নীরবতা কি চিরকাল থাকবে?আবু বকরের মতো আর কতজন হারিয়ে যাবে?
আজ, ৩ ফেব্রুয়ারি। শহীদ আবু বকরের ১৫তম শাহাদাত বার্ষিকী। প্রশ্ন জাগে—আমরা কি তাকে মনে রেখেছি? নাকি সে-ও হারিয়ে গেছে বিচারহীনতার গহ্বরে?
পাঠকের মতামত:
সর্বোচ্চ পঠিত
- তিন কোম্পানির কারখানা বন্ধ, ক্ষোভ বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের
- আইসিবি’র বিশেষ তহবিলের মেয়াদ ২০৩২ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি
- কেয়া কসমেটিক্সের ৮ হাজার কোটি টাকা উধাও, চার ব্যাংককে তলব
- সম্ভাবনার নতুন দিগন্তে শেয়ারবাজারের খান ব্রাদার্স
- ব্লুমবার্গের টেকসই তালিকায় বাংলাদেশের ১১ তালিকাভুক্ত কোম্পানি
- মূলধন ঘাটতিতে দুই ব্রোকারেজ হাউজ, ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ
- দুই খবরে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ শেয়ারের চমক
- ২৩ আগস্ট : শেয়ারবাজারের সেরা ৮ খবর
- সাকিবের মোনার্কসহ ৮ ব্রোকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ
- চলতি বছর শেয়ারবাজারে আসছে রাষ্ট্রায়াত্ব দুই প্রতিষ্ঠান
- হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রতারণা, বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করল ডিএসই
- বিএসইসির নতুন মার্জিন বিধিমালার খসড়া অনুমোদন
- কোম্পানির অস্বাভাবিক শেয়ারদর: ডিএসইর সতর্কবার্তা
- শেয়ারবাজারের জন্য সুখবর: কমছে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদ
- বিমা আইন সংস্কার: বিনিয়োগ ও আস্থায় নতুন দিগন্ত