ঢাকা, শনিবার, ১ নভেম্বর ২০২৫, ১৭ কার্তিক ১৪৩২

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের পর নেপাল

দক্ষিণ এশিয়া কি জেন-জি বিপ্লবের উর্বর ভূমি?

মোবারক হোসেন
মোবারক হোসেন

সিনিয়র রিপোর্টার

২০২৫ সেপ্টেম্বর ১৬ ১১:৪১:৫০

দক্ষিণ এশিয়া কি জেন-জি বিপ্লবের উর্বর ভূমি?

মোবারক হোসেন: লোহার গেট ভেঙে এগিয়ে চলা জনতার ঢল, ক্ষমতার প্রতীকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ব্যারিকেড কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে পড়ল। ক্ষমতাধরদের বিলাসবহুল বাড়ির ভেতরে ধ্বনিত হলো কাদামাখা পায়ের শব্দ। কেউ জানালা-দরজা ভাঙল, কেউবা সংগ্রহ করল দামি চাদর ও জুতা। যে ভবন এত দিন ছিল দুর্ভেদ্য কর্তৃত্বের প্রতীক, কয়েক ঘণ্টার জন্য সেটি হয়ে উঠল সাধারণ মানুষের দখলে।

এ দৃশ্য শুধু নেপালের নয়—২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশও একই দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছে।

প্রশ্ন জাগছে: দক্ষিণ এশিয়াই কি হয়ে উঠছে জেনারেশন-জেড বিপ্লবের কেন্দ্রস্থল?

গত সপ্তাহে নেপালে তিন দিনের বিক্ষোভে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে লাখো তরুণ। নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নে নিহত হয় ৭০ জনের বেশি। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি বিক্ষোভকারীদের বিদ্রূপ করার কয়েক দিনের মধ্যেই পদত্যাগে বাধ্য হন।

অসন্তুষ্ট তরুণেরা এমনকি ডিসকর্ড প্ল্যাটফর্মে অনলাইন ভোটের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর নামও ঘোষণা করেছে—যা প্রচলিত গণতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে এক অভিনব ঘটনা।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমে রূপ নেয় সরকারবিরোধী সর্বাত্মক আন্দোলনে। পুলিশি দমন-পীড়নে শত শত মানুষ নিহত হয়। আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়ে হেলিকপ্টারে করে ভারতে আশ্রয় নেন।

শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালে অর্থনৈতিক সংকটে জ্বালানি ও খাদ্য ঘাটতি চরমে পৌঁছালে “আরাগালায়া” নামের আন্দোলনে তরুণরা রাস্তায় নামে। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।

কেন জেন-জি পথে নেমেছে?

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের ক্ষোভের পেছনে রয়েছে একই ভিত্তি—বৈষম্য, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে প্রজন্মগত অমিল। এই প্রজন্ম দুইবার বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কা দেখেছে, মহামারির সময় বিচ্ছিন্ন থেকেছে, আবার একই সঙ্গে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অভ্যস্ত হয়েছে। অথচ তাদের শাসন করছিল দাদু-দিদিমার বয়সী নেতারা—নেপালের অলি ছিলেন ৭৩, বাংলাদেশের হাসিনা ৭৬, শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে ৭৪।

গাঙ্গুলি বলেন, “তরুণদের সঙ্গে নেতাদের ব্যবধান এতটাই বেশি হয়ে গিয়েছিল যে সেই অসামঞ্জস্য আর টিকিয়ে রাখা যায়নি।”

অভিন্ন সুর, অভিন্ন কৌশল

শুধু দেশভিত্তিক অভিযোগ নয়—এই আন্দোলনগুলোতে উঠে এসেছে কর্মসংস্থান, ন্যায়বিচার ও ভবিষ্যৎ রক্ষার দাবিও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইন, বিকেন্দ্রীকৃত নেতৃত্ব ও ডিজিটাল সমন্বয় একে অপরের কাছ থেকে শেখা নতুন কৌশল হয়ে উঠেছে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, “এখানে তরুণদের অভিন্ন শক্তি হলো ভবিষ্যতের ভালো কল্পনা করার সাহস এবং সেই কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান দেখতে পাওয়া।”

পরবর্তী ঝড় কোথায়?

জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি এখনো ২৮ বছরের নিচে—অশিক্ষিত হার কমছে, অথচ বৈষম্য ও অর্থনৈতিক সংকট বেড়েই চলছে। ফলে আন্দোলনের উর্বর মাটি ছড়িয়ে আছে পুরো অঞ্চলে।

কোলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রুমেলা সেনের ভাষায়, “এখানে আসলে দেখা যাচ্ছে গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তি, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা।”

নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে—দক্ষিণ এশিয়ার তরুণরা একে অপরের কাছ থেকে শিখছে, অনুপ্রাণিত হচ্ছে, এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই হাতে তুলে নিতে চাইছে।

প্রশ্ন এখন কেবল একটাই: পরবর্তী বিস্ফোরণ কোথায় ঘটবে?

এমজে

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত