ঢাকা, মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮ ভাদ্র ১৪৩২
গণভবনেই গণহ'ত্যার পরিকল্পনা: ট্রাইব্যুনালে মামুনের জবানবন্দি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলন দমনের জন্য 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঠেকাতে ৪ আগস্ট রাতেই গণভবনে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সেই বৈঠকেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ‘লেথাল উইপেন’ (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়।
আজ মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেওয়ার সময় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান।
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ৩৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন চৌধুরী মামুন। বেলা পৌনে ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তার সাক্ষ্যগ্রহণ চলে।
চৌধুরী মামুন তার জবানবন্দিতে বলেন, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির একটি বৈঠক হয়। সেখানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিজিএফআই-এনএসআই প্রধানসহ কমিটির ২৭ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিজেও ওই বৈঠকে ছিলেন। বৈঠকে আন্দোলন দমন ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা হয় এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে প্রতিবেদন পেশ করে। এক পর্যায়ে দ্রুত পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে বৈঠক মুলতবি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ওই রাতেই আবার তাদের গণভবনে ডাকা হয়। সেই বৈঠকে তিনি নিজে, আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাব ডিজি এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ রেহানাও উপস্থিত ছিলেন। ডিজিএফআই ও এসবিপ্রধান বাইরে অপেক্ষমাণ ছিলেন। এই বৈঠকে ৫ আগস্টের 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয় এবং পুলিশ-সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর তারা আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যান এবং ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মিটিং শেষে রাত সাড়ে ১২টায় তারা চলে আসেন।
সাবেক এই পুলিশপ্রধান জানান, ৫ আগস্ট সকালে তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিজের দপ্তরে যান। এর মধ্যে উত্তরা-যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা প্রবেশ করতে থাকে। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে জানতে পারেন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি কোথায় যাবেন তা তারা জানতেন না। এরপর বিকেলে আর্মির হেলিকপ্টার এসে তাকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে এবং সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যায়। হেলিকপ্টারে তার সঙ্গে এসবিপ্রধান মনিরুল, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিব ও ডিআইজি আমেনা ছিলেন। পরের ধাপে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়, এডিশনাল আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যদেরও সেখানে নিয়ে আসা হয়।
চৌধুরী মামুন বলেন, ৬ আগস্ট আইজিপি হিসেবে তার নিয়োগ চুক্তি বাতিল করা হয় এবং ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালীন ৩ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ২৭ জুলাই আন্দোলন চলাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল, স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ তারা নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখতে যান। যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে অবস্থানকালে ওয়ারী জোনের ডিসি ইকবাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি ভিডিও প্রদর্শন করে বলেন, "গুলি করি, একজন মরে, একজন আহত হয়। সেই যায়। বাকিরা যায় না।"
চৌধুরী মামুন জানান, ১৮ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাকে ফোন করে জানান যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি লেথাল উইপেন ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই সময় তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ছিলেন এবং তার সঙ্গে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়ও ছিলেন। এই নির্দেশনার বিষয়টি জানানোর পর প্রলয় ডিএমপি কমিশনারসহ সারাদেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেন। এরপর থেকেই আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়। মারণাস্ত্র ব্যবহারে ডিএমপি কমিশনার হাবিব এবং ডিবির হারুন অতিউৎসাহী ছিলেন বলে তিনি দাবি করেন। মূলত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল যেকোনোভাবে আন্দোলন দমাতে হবে।
তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে প্রধানমন্ত্রীকে প্ররোচিত করেন কামাল, আনিসুল, ফজলে নূর তাপস, সালমান এফ রহমান, ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মির্জা আযম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননসহ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও আন্দোলন দমনে সরকারকে উৎসাহিত করেন আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও ব্যবসায়ীরা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকারের আদেশে ছাত্র-জনতার ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে আহত-নিহত করায় পুলিশপ্রধান হিসেবে লজ্জিত ও অনুতপ্ত বলে দুঃখ প্রকাশ করেন সাবেক এই পুলিশপ্রধান।
তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাসহ ব্যাপক নৃশংসতার জন্য তিনি অপরাধবোধ করছেন। বিবেকের তাড়নায় তিনি রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালে এসে স্বজন হারানোদের কান্না-আহাজারি শুনে ও ভিডিওতে নৃশংসতা দেখে রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত আরও যৌক্তিক মনে হয়েছে। বিশেষ করে আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর বীভৎসতা তাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে।
চৌধুরী মামুন তার জবানবন্দিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশেই এই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তবে তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন এসব সংঘটিত হওয়ায় নিজেও দায় স্বীকার করেন এবং একইসঙ্গে গণহত্যার শিকার প্রত্যেক পরিবার, আহত ব্যক্তিবর্গ, দেশবাসী ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেন, "আমাকে দয়া করে ক্ষমা করবেন।"
এসপি
পাঠকের মতামত:
সর্বোচ্চ পঠিত
- বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে শেয়ারবাজারের ১১ কোম্পানিতে
- কোম্পানি পুরোদমে উৎপাদনে, তারপরও শঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা!
- চলতি বছর শেয়ারবাজারে আসছে রাষ্ট্রায়াত্ব দুই প্রতিষ্ঠান
- মার্জারের সাফল্যে উজ্জ্বল ফার কেমিক্যাল
- তালিকাভুক্ত কোম্পানির ১৫ লাখ শেয়ার কেনার ঘোষণা
- শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর প্রথম ‘নো ডিভিডেন্ড’
- বিমা আইন সংস্কার: বিনিয়োগ ও আস্থায় নতুন দিগন্ত
- তদন্তের খবরে থামছে দুই কোম্পানির ঘোড়দৌড়
- ডেনিম উৎপাদন বাড়াতে এভিন্স টেক্সটাইলসের বড় পরিকল্পনা
- শেয়ারবাজারে রেকর্ড: বছরের সর্বোচ্চ দামে ১৭ কোম্পানি
- চলতি সপ্তাহে ঘোষণা আসছে ৫ কোম্পানির ডিভিডেন্ড-ইপিএস
- তিন কোম্পানির অস্বাভাবিক শেয়ারদর: ডিএসইর সতর্কবার্তা
- পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার
- ব্যাখ্যা শুনতে ডাকা হচ্ছে শেয়ারবাজারের পাঁচ ব্যাংককে
- ব্যাংকিং খাতে এমডিদের পদত্যাগের ঢেউ: সুশাসনের সংকট স্পষ্ট