ঢাকা, শুক্রবার, ৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

শেয়ারবাজারে লবিস্ট ঠেকাতে 'পর্যবেক্ষক সংস্থা' গঠনের প্রস্তাব

ডুয়া নিউজ- শেয়ারবাজার
২০২৫ জুলাই ০৪ ২২:৫৬:০৫
শেয়ারবাজারে লবিস্ট ঠেকাতে 'পর্যবেক্ষক সংস্থা' গঠনের প্রস্তাব

দেশের শেয়ারবাজারকে লবিস্টদের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে এবং সিকিউরিটিজ নিয়ন্ত্রক সংস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি সাত সদস্যের পর্যবেক্ষক সংস্থা (Oversight Body) গঠনের সুপারিশ করেছে শেয়ারবাজার টাস্কফোর্স। এই সংস্থা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ থেকেও বাজারকে রক্ষা করবে বলে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর কাছে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে টাস্কফোর্স জানিয়েছে, প্রস্তাবিত পর্যবেক্ষক সংস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও রাজস্ব কর্তৃপক্ষের প্রধান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সচিব এবং বাজার বিশেষজ্ঞরা থাকবেন।

টাস্কফোর্স দৃঢ়ভাবে বলছে, এই পর্যবেক্ষক সংস্থা গঠনের জন্য একটি আইনি কাঠামো থাকা উচিত, যাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এর নির্দেশনা ও পরামর্শ মানতে বাধ্য থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টাস্কফোর্সের একজন সদস্য বলেছেন, সংস্থাটি কোম্পানি বা সংস্থাগুলির বোর্ডের মতো ভূমিকা পালন করবে।

এই ধরনের একটি সংস্থা গঠনের সুপারিশ এমন সময়ে এলো, যখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে পূর্ববর্তী কমিশন এবং মন্ত্রণালয়ের বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে এবং বাজার মধ্যস্থতাকারীদের পাশ কাটিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

মিউচুয়াল ফান্ডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব

মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটহোল্ডাররাই সাধারণত ফান্ড পরিচালনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হন। কিন্তু ২০১৮ সালে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সিদ্ধান্তের পর সিকিউরিটিজ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ক্লোজ-এন্ডেড মিউচুয়াল ফান্ডগুলির মেয়াদ ১০ বছর বাড়িয়ে দেয়। অভিযোগ রয়েছে, অসাধু ফান্ড ম্যানেজারদের লবিংয়ের প্রভাবে মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর ফলে নির্বাচিত সম্পদ ব্যবস্থাপকরা নিয়মিতভাবে ম্যানেজমেন্ট ফি অর্জন করতে থাকেন। যদিও তাদের দ্বারা পরিচালিত ফান্ডগুলো ইউনিটহোল্ডারদের জন্য কোনো রিটার্ন নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে, বিনিয়োগকারীরা ফান্ড ম্যানেজার এবং পুলড ফান্ডের প্রতি আস্থা হারান, যা এই খাতের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে। টাস্কফোর্স মনে করে, ইউনিটহোল্ডারদের স্বার্থ বিবেচনা না করে মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া উচিত ছিল না।

অযাচিত প্রভাবের আরেকটি উদাহরণ হলো- বিএসইসিকে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের আগে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। প্রায় প্রতি বছরই নিয়ন্ত্রক সংস্থা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকায় বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশে বিলম্ব হয়। প্রস্তাবিত পর্যবেক্ষক সংস্থা বিএসইসিকে মন্ত্রণালয়ের প্রভাব থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে সাহায্য করবে এবং একইসাথে সিকিউরিটিজ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বাজার, বিনিয়োগকারী এবং স্টেকহোল্ডারদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আইপিও অনুমোদনে একক ক্ষমতা

বিএসইসি স্টক এক্সচেঞ্জগুলির আপত্তি সত্ত্বেও অনেক আইপিও (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদ রিং শাইন টেক্সটাইলস-এর আইপিও প্রস্তাব অনুমোদন না করার জন্য সিকিউরিটিজ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোম্পানিটিকে তহবিল সংগ্রহের অনুমতি দেয় এবং পরবর্তীতে কোম্পানির মালিকরা বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।

ফ্লোর প্রাইস আরোপ নিয়ে প্রশ্ন

ফ্লোর প্রাইস আরোপ ছিল আরেকটি পদক্ষেপ যা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে বাজারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, যার ফলে বর্তমানে বিদেশী বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। টাস্কফোর্স বলছে, বিএসইসির কাজ নীতি নির্ধারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত এবং বাজার পরিচালনার সিদ্ধান্তগুলি এক্সচেঞ্জগুলির উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।

কমিশন গঠন ও আইনি কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা

মন্ত্রণালয় বিএসইসিতে কমিশনার ও চেয়ারম্যান নিয়োগ করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহলের লবিংয়ের কারণে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। টাস্কফোর্সের মতে, বিএসইসি চেয়ারম্যান এবং কমিশনারদের পর্যবেক্ষক সংস্থা দ্বারা গঠিত একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ করা উচিত, যারা নির্ধারণ করবেন কোন যোগ্য প্রার্থীরা এই ভূমিকার জন্য উপযুক্ত। টাস্কফোর্সের এক সদস্য বলেন, যেহেতু পর্যবেক্ষক সংস্থায় এফআইডি সচিব অন্তর্ভুক্ত থাকবেন, তাই বাজারের কার্যক্রমে মন্ত্রণালয়েরও একটি ভূমিকা থাকবে।

আইনি কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে টাস্কফোর্স বিএসইসির একটি উপদেষ্টা সংস্থার উদাহরণ দিয়েছে যা কখনও কার্যকরী ছিল না। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের পর সিকিউরিটিজ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ২০১১ সালের মার্চে 'উচ্চ প্রোফাইল' একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিল, যা প্রয়োজনে নীতি পরিবর্তন প্রস্তাব করার কথা ছিল। কিন্তু কমিটি ২০১৪ সালে মাত্র একবার বসেছিল। এরপর বাজার অনেক সংকটের মধ্য দিয়ে গেলেও বিএসইসি এই উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক করেনি। এই কমিটিতে বিএসইসি চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এফবিসিসিআই-এর প্রতিনিধিগণ এবং অর্থনীতিবিদরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। উপদেষ্টা কমিটি শেষ পর্যন্ত ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, যা পর্যবেক্ষক সংস্থার উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করার জন্য একটি আইনি কাঠামোকে অপরিহার্য করে তোলে।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত