ঢাকা, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

দুবাই যখন ভারতের অংশ ছিল, ইতিহাসের অলিখিত কাহিনি!

ডুয়া নিউজ- আন্তর্জাতিক
২০২৫ জুন ২৮ ১৪:৩৪:১৭
দুবাই যখন ভারতের অংশ ছিল, ইতিহাসের অলিখিত কাহিনি!

সময়টা ছিল ১৯৫৬ সালের শীতকাল। দ্য টাইমসের সংবাদদাতা ডেভিড হোল্ডেন তখন বাহরাইন দ্বীপে পা রাখেন। বাহরাইন তখন ছিল একটি ব্রিটিশ প্রটেক্টরেট—অর্থাৎ অভ্যন্তরীণভাবে স্বাধীন হলেও বৈদেশিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তার জন্য নির্ভর করতে হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ওপর। এই ব্যবস্থা শুধু বাহরাইন নয় গোটা উপসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে ছিল বিস্তৃত।

হোল্ডেন আগে ভূগোলের শিক্ষক ছিলেন পরে আশায়-ভরসায় এই আরব অঞ্চলে পাড়ি জমান। তিনি যেখানে গেছেন—দুবাই, আবুধাবি, ওমান—সেখানে সর্বত্র খুঁজে পেয়েছেন ব্রিটিশ ভারতের ছাপ। স্থানীয় ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলোতেও ছিল সেই প্রভাব: পরিচারকদের বলা হতো "বেয়ারা", ধোপা মানেই "লন্ড্রিম্যান" আর পাহারাদার "চৌকিদার"।

সেই সময়কার সামাজিক রীতিতেও ছিল ভারতীয় রাজকীয়তার ছোঁয়া—রবিবার দুপুরের ভোজে পরিবেশিত হতো ভারতীয় মশলাদার বিরাট কারি। এমনকি ওমানের সুলতানও ভারতের রাজস্থানে পড়াশোনা করেছিলেন এবং উর্দুতে ছিলেন আরবির চেয়েও বেশি সাবলীল। তার সৈন্যদের পোশাকও ছিল হায়দরাবাদি স্টাইলে।

এই অঞ্চলের প্রশাসনিক কাঠামো ছিল ব্রিটিশ ভারতের অধীন। অ্যাডেন থেকে কুয়েত পর্যন্ত বহু প্রটেক্টরেট ছিল দিল্লির তত্ত্বাবধানে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতো ভারতীয় বাহিনী এবং তদারকি করতেন 'ইন্ডিয়ান পলিটিকাল সার্ভিস'-এর কর্মকর্তারা। ১৮৮৯ সালের ইন্টারপ্রেটেশন অ্যাক্ট অনুসারে এসব অঞ্চল আইনগতভাবে ভারতের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো।

জয়পুর বা হায়দরাবাদের মতো দেশীয় রাজ্যের তালিকায় শীর্ষে ছিল আবুধাবি। এমনকি লর্ড কার্জন প্রস্তাব দিয়েছিলেন ওমানকে ভারতীয় সাম্রাজ্যের দেশীয় প্রদেশ হিসেবে গ্রহণ করার।

এমনও সময় ছিল যখন অ্যাডেন ছিল বম্বে প্রদেশের অধীন। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৯৩১ সালে সেখানে গিয়েছিলেন। তখন অনেক আরব তরুণ নিজেকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদী’ হিসেবে পরিচয় দিত।

তবে এই সম্পর্ক ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক গোপন অধ্যায়। তুরস্ক বা সৌদি আরব যেন ক্ষুব্ধ না হয় সেই আশঙ্কায় এই আরব অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে খুব কম তথ্যই জনসমক্ষে আনা হতো।

ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় আরব অঞ্চল থেকেও সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিন্তু শেষমেশ শুধু ভারত থেকেই সরে আসে। উপসাগরীয় অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়ে যায় আরও ২৪ বছর। তখন ‘ভারতের বড়লাট’ এর বদলে কর্তৃত্ব চলে যায় ‘হোয়াইটহল’-এর (ব্রিটিশ সরকারের কেন্দ্র) হাতে।

পল রিচ নামের এক বিশেষজ্ঞ একে তুলনা করেছেন ফরাসিদের পন্ডিচেরি বা পর্তুগিজদের গোয়ার শেষ উপনিবেশের সঙ্গে। ব্রিটিশ ভারতীয় শাসনের সর্বশেষ স্মৃতি ছিল এই উপসাগরীয় অঞ্চল।

১৯৭১ সালে সবশেষে ব্রিটিশরা এই অঞ্চল ছেড়ে যায়। তখন ডেভিড হোল্ডেন লিখেছিলেন, ‘এই প্রথমবার উপসাগরের দেশগুলো নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে তবে ব্রিটিশদের নিরাপত্তা আর পাবে না।’

আজকের উপসাগরীয় দেশগুলোর জাতীয় ইতিহাসে এই ভারতীয় অধ্যায় প্রায় মুছে গেছে। তারা মনে রাখে ব্রিটিশদের কিন্তু ভুলে গেছে দিল্লির কর্তৃত্ব। এই ইতিহাসের পর্দা তুললে দেখা যায় একসময় যেসব এলাকা ছিল ভারতীয় সাম্রাজ্যের প্রান্তিক অংশ—আজকের দিন তারা দাঁড়িয়ে আছে নিজেদের গৌরবময় পরিচয়ে যেমন দুবাই।

আর যে ভারতীয় বা পাকিস্তানি নাগরিকেরা এখন সেখানে শ্রমিক হিসেবে যান তাদের অনেকেই জানেন না য, এককালে তারাই ছিল এই অঞ্চলের প্রভু শ্রেণী।

দুবাই—যা এক সময় ভারতীয় প্রশাসনের এক নগণ্য প্রান্তিক অঞ্চল ছিল—আজ মধ্যপ্রাচ্যের এক জ্বলজ্বলে কেন্দ্র। সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে সেই ইতিহাস। এখন শুধু কানে ভেসে আসে তারই প্রতিধ্বনি।

তথ্য : বিবিসি বাংলা।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

‘মার্চ টু এনবিআর’ ঘিরে সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

‘মার্চ টু এনবিআর’ ঘিরে সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের অপসারণ ও অংশগ্রহণমূলক সংস্কারের দাবিতে ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি শুরু করেছেন রাজস্ব বিভাগের আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।... বিস্তারিত