ঢাকা, সোমবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

সংখ্যালঘুদের প্রতি নরম তালেবান, নাকি কৌশলগত নাটক?

২০২৫ অক্টোবর ১৯ ০২:১৫:৫৫

সংখ্যালঘুদের প্রতি নরম তালেবান, নাকি কৌশলগত নাটক?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি, সে দেশ থেকে ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানো হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের দেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, এই হিন্দু ও শিখরা আফগানিস্তানে ফিরলে তাদের পুরনো সম্পত্তি ও ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সরকার সাহায্য করবে।

সম্প্রতি মুত্তাকির ভারত সফরের সময় দিল্লির আফগান দূতাবাসে ১৩ জন হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীর (যারা সবাই সে দেশ থেকে চলে এসেছেন) একটি প্রতিনিধিদল তার সঙ্গে দেখা করলে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দেন। তবে এই আফগান নাগরিকরা মনে করছেন, এখনও তাদের দেশে ফেরার মতো নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়নি। তারা বরং তালেবান সরকারের কাছে অবশিষ্ট কয়েকটি হিন্দু মন্দির ও শিখ গুরুদুয়ারার রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন, যা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করবে।

বর্তমানে পুরো আফগানিস্তানে মাত্র ৫০ জনের মতো হিন্দু ও শিখ রয়ে গেছেন বলে ওই প্রতিনিধিদলের হিসাব। তারা বিভিন্ন শিখ গুরুদুয়ারা ও হিন্দু মন্দিরগুলোতে পূজা-পাঠ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং ওই সম্পত্তিগুলোর যাতে আর কোনো ক্ষতি না হয়, সেই চেষ্টা করছেন।

দিল্লিতে এই প্রতিনিধিদলের সদস্যরা যখন মুত্তাকির সঙ্গে দেখা করেন, তিনি তাদের বলেন, "আফগানিস্তান আপনাদের দেশ, আপনাদের জন্মভূমি। আপনারা যখন খুশি নিজেদের দেশে ফিরে আসুন, যেসব ব্যবসাপাতি বা দোকানপাট ফেলে গেছেন সেগুলোর আবার চালু করুন!"

তবে 'আফগান হিন্দু শিখ ওয়েলফেয়ার সোসাইটি'র প্রেসিডেন্ট হরভজন সিং বলছেন, "জীবনের দাম সবার আগে। নিজেদের জন্মভূমিকে কে না ভালবাসে, কিন্তু ওখানে যাওয়ার পর আমরা খুন হয়ে গেলে আমাদের পরিবারকে কে দেখবে বলুন?"

আফগান মাইনরিটিজ কাউন্সিলের সদস্য গুলজিত সিং, যিনি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন, জানান যে তারা মনে করেন না আফগানিস্তানে তাদের ফেরার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে তারা চান তালেবান সরকার ধর্মীয় স্থানগুলো রক্ষা করার সুযোগ দিক। এর জন্য তারা মন্ত্রীর কাছে ৩০ জনকে মাল্টিপল এন্ট্রি/এক্সিট ভিসা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন, যাতে তারা গুরুদুয়ারা বা মন্দিরগুলোর দেখাশোনা করে আবার পরিবারের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন।

তালেবান সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রীর প্রকাশ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশে ফেরার আমন্ত্রণ জানানো এবং ব্যবসাপাতি ফিরে পেতে সাহায্য করার কথা বলাকে অনেক পর্যবেক্ষক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। মুত্তাকি দিল্লির দূতাবাসে যে কক্ষে হিন্দু ও শিখ প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন, সেখানে তার মাথার ওপর বামিয়ান উপত্যকায় বুদ্ধের দুটি মূর্তির ছবি ছিল, যা ২০০১ সালে তৎকালীন তালেবান সরকারের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এই ছবি টাঙিয়ে রেখে তালেবান সম্ভবত এই বার্তা দিতে চেয়েছে যে তারা এখন দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারকেও মর্যাদা দেয়।

আফগান অ্যাফেয়ার্স বিশেষজ্ঞ কবীর তানেজা মনে করেন, "তালেবান কাবুলের ক্ষমতা ফিরে পেলেও এখনও তারা আন্তর্জাতিক দুনিয়ার স্বীকৃতি তেমন পায়নি বললেই চলে। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে মরিয়া বলেই মুত্তাকি দিল্লি সফরে এসেছিলেন এবং এখানে এসে তিনি যথারীতি এমন বার্তাই দিতে চাইবেন যা মোদি সরকারকে খুশি করবে।"

মুত্তাকির সফরের দ্বিতীয় দিনেই দিল্লিতে তার সাংবাদিক সম্মেলনে কোনো নারী সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, যা তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। 'ড্যামেজ কন্ট্রোল' করতে দুই দিন পর আর একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তাতে নারী সাংবাদিকরাও আমন্ত্রিত ছিলেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশে ফেরার আহ্বান জানানোও তালেবান সরকারের একই রকম একটি 'ইমেজ মেরামতের' চেষ্টা বলেই মনে করেন কবীর তানেজা।

দিল্লি, আগ্রা, দেওবন্দজুড়ে সপ্তাহব্যাপী সফর শেষে আমির খান মুত্তাকি কাবুলে ফিরে গেছেন গত বুধবার (১৫ অক্টোবর)। কিন্তু তিনি ভারত ছাড়ার আগেই তার একটি 'ভিডিও' ভারতের সোশ্যাল মিডিয়াতে তীব্র বেগে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, "আমি নরেন্দ্র মোদিজিকে বলেছি, আপনারা যদি তালেবানকে কিছু ডলার দেন, তাহলে আমরা কাবুল, কান্দাহার ও হেলমান্দে ভগবান বিষ্ণু ও ভগবান শিবের মন্দির বানাবো। যাতে ভারত থেকে হিন্দু তীর্থযাত্রীরা আফগানিস্তানে তীর্থ করতে যেতে পারেন।" আরও বলতে শোনা যায়, "আমরা জয় শ্রীরাম ধ্বনিও দিয়েছি। আমরা মোদিজির প্রতি কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করছেন।"

ভারতের যে হিন্দুত্ববাদী ও রাইট উইং ইকোসিস্টেম সোশ্যাল মিডিয়াতে সক্রিয়, তার সমর্থকরা এই ভিডিও নিমেষে ভাইরাল করে তোলেন। ইতিমধ্যে ভারতের বিভিন্ন ফ্যাক্ট চেকিং সাইট এর সত্যতা যাচাই করে প্রমাণ পায় যে এটি আসলে এআই দিয়ে বানানো ভিডিও ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু ততক্ষণে এই 'ফেক নিউজ' ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়েছে। পরে দিল্লিতে আফগান দূতাবাসও জানায়, এই ভিডিওটি অসত্য। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। আর ভারতেও লাখ লাখ মানুষ বিশ্বাস করে ফেলেছেন যে তালেবান বোধহয় সত্যিই মোদিজির সম্মানে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান দিচ্ছে!

এসপি

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত