ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১ কার্তিক ১৪৩২

প্রতিবেশী দেশগুলির চেয়ে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেশি কেন?

২০২৫ অক্টোবর ১৬ ২২:২৩:০২

প্রতিবেশী দেশগুলির চেয়ে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেশি কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক: সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে স্বর্ণের দামে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, তবে প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের তুলনায় বাংলাদেশে এই মূল্যবান ধাতুর মূল্য অনেক বেশি। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যা বর্তমানে ২২ ক্যারেট প্রতি ভরি ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ এবং এর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি ট্রয় আউন্স (৩১.১০ গ্রাম) স্বর্ণের দাম প্রথমবারের মতো চার হাজার দুইশ ডলারের ঘরে পৌঁছেছে। ২০২২ সালের শুরুতে যা ছিল দুই হাজার ডলারের নিচে। ২০২৩ সালের পর থেকে স্বর্ণের দাম কেবলই ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্ব বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও স্বর্ণের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) জানিয়েছে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম লাখের ঘরে পৌঁছায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে স্বর্ণের দামের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যুদ্ধ কিংবা অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে এর দামে এক ধরনের প্রভাব পড়ে। করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক অস্থিরতা স্বর্ণকে একটি নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, ফলে এর চাহিদা বেড়েছে।

তবে, আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ কারণও দায়ী। সরকারের দুর্বল নীতিমালা, ডলারের বিপরীতে টাকার মানের পতন এবং ব্যবসায়ীদের মুনাফা করার প্রবণতা এই মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আপদকালীন সম্পদ হওয়ায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যক্তিখাতের বড় বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণ ক্রয় ও সংরক্ষণ বাড়িয়ে দেন, যা বিশ্বে এই ধাতুর চাহিদা ও প্রাপ্যতার মধ্যে অসামঞ্জস্য তৈরি করে।

স্বর্ণের চাহিদা বাড়লেও এর উৎপাদন অসীম নয়। ২০২৩ সালে বিশ্বে চার হাজার ৯৪৬ টন স্বর্ণ সরবরাহ করা হয়, যা গত বছর বেড়ে চার হাজার ৯৭৫ টন হয়েছে। তবে এই সময়ে বৈশ্বিক নানা কারণে স্বর্ণে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়িয়েছে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যক্তিখাতের বড় বিনিয়োগকারীরা।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের ১৫ অক্টোবরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২২ ক্যারেটের প্রতি গ্রাম স্বর্ণের দাম ১৫২.৩৯ ডলার বা ১৮ হাজার ৫৪৭ টাকা। একই সময়ে, ভারতে প্রতি গ্রামের দাম ১৩৪.৭০ মার্কিন ডলার, পাকিস্তানে ১৩৬.৯৪ মার্কিন ডলার, নেপালে ১২৫.০৫ মার্কিন ডলার, মালয়েশিয়ায় ১৩১.১৪ মার্কিন ডলার, সৌদি আরবে ১২৬.৯১ ডলার এবং কাতারে ১২৭.৯৭ ডলার। এই তুলনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম অনেকটাই বেশি।

বাজুসের সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান জানান, আমদানির সুযোগ না থাকায় অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে স্বর্ণ ক্রয়, ডলারের বিপরীতে টাকার অবনমনসহ নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়। তিনি বলেন, সরকার যদি স্বর্ণ আমদানি করতো বা সেন্ট্রাল ব্যাংক যদি তাদের গোল্ড দিতো, তাহলে স্বর্ণের বাজার আরও নিয়ন্ত্রিত থাকতো। বর্তমানে 'রিসাইকেল গোল্ডের' ওপর নির্ভরতার কারণে দামে পার্থক্য হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বর্ণে বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ বা ঝুঁকিপূর্ণ, তা বলা কঠিন। তবে অতীত অভিজ্ঞতা এবং বাজার প্রবণতা বিবেচনায় এর দাম আগামী কয়েক বছরে কমার সম্ভাবনা নেই, বরং আরও বাড়তে পারে। গোল্ডম্যান স্যাকস পূর্বাভাস দিয়েছে যে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম চার হাজার ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, স্বর্ণের দামের সঙ্গে অনিশ্চয়তার একটি সম্পর্ক রয়েছে এবং এটি ব্যাংকিং সুদের হারের ওপরও নির্ভর করে। তিনি উল্লেখ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত এবং ডলারের সুদের হারের ওপর স্বর্ণের বাজার অনেকটা নির্ভর করে। বাংলাদেশে স্বর্ণের বাড়তি দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেসব দেশে স্বর্ণ উৎপাদন হয় এবং সরকারিভাবে আমদানির সুযোগ রয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে দামের মিল না থাকা স্বাভাবিক। তবে বাজারের ওপর কেবল ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে এবং স্বর্ণ চোরাচালানের সুযোগও তৈরি করে।

এসপি

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত