ঢাকা, বুধবার, ২৭ আগস্ট ২০২৫, ১২ ভাদ্র ১৪৩২

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক: ভারতের কপালে চিন্তার ভাঁজ

ডুয়া নিউজ- জাতীয়
২০২৫ আগস্ট ২৭ ২৩:৩৫:৩৬
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক: ভারতের কপালে চিন্তার ভাঁজ

মাত্র কয়েক মাস আগেও ভারত যেখানে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট (সার্ক) পুনরুজ্জীবিত করার বাংলাদেশের প্রস্তাবকে সরাসরি ‘পাকিস্তানের সুরে সুর মেলানো’ বলে নাকচ করে দিয়েছিল, সেখানে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা নয়াদিল্লির কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা যেভাবে দ্রুত বাড়ছে, তা ভারতের নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফর এই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সফরে তিনি শুধু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেই নয়, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপির মতো দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। এমনকি ঢাকার মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি একাত্তরের গণহত্যাকে ‘মীমাংসিত বিষয়’ বলে অভিহিত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান, যা ভারতের বিশ্লেষকদের মতে, একাত্তরের ইতিহাসকে লঘু করে দেখানোর পাকিস্তানি পুরোনো কৌশলেরই প্রতিফলন।

ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হলো দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা। বিগত এক দশকে শেখ হাসিনা সরকারের কঠোর নীতির কারণে ওই অঞ্চলে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার আশঙ্কা করছে দিল্লি। ভারতের সাবেক শীর্ষ কূটনীতিক ভিনা সিক্রি, যিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ঢাকায় হাইকমিশনার ছিলেন, তিনি বর্তমান পরিস্থিতিকে একটি ‘ডেজাঁ ভু’ বা পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখছেন। তিনি ২০০৪ সালের ১০ ট্রাক অস্ত্র চালানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, সে সময়ও বাংলাদেশের মাটিকে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হতো। ভারতের প্রতিরক্ষা প্রধান জেনারেল অনিল চৌহানও সম্প্রতি প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে, চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বার্থের মধ্যে এক ধরনের ‘অভিন্নতা’ দেখা যাচ্ছে, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।

লন্ডনের ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রিয়জিৎ দেব সরকারের মতে, এই নতুন সমীকরণের পেছনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিরও প্রভাব রয়েছে। ট্রাম্প দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে একক প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে না দেখে, ভারত ও পাকিস্তানকে একই কাতারে ফেলার চেষ্টা করছেন এবং বাংলাদেশকে সেই সমীকরণে যুক্ত করতে চাইছেন। এর ফলে ওয়াশিংটন এখন আর দিল্লির চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখছে না। পাকিস্তান এই সুযোগটি লুফে নিয়েছে, কারণ ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বাংলাদেশকে পাশে পাওয়া তাদের ‘ব্লিড ইন্ডিয়া উইথ আ থাউজ্যান্ড কাটস’ (হাজারো আঘাতে ভারতকে রক্তাক্ত করা) নীতির সঙ্গে মিলে যায়।

ভারতের জন্য এটি শুধু সামরিক বা নিরাপত্তাগত উদ্বেগের বিষয় নয়, এটি একটি আদর্শিক লড়াইও বটে। বিশ্লেষক শান্তনু মুখার্জির মতে, পাকিস্তান এখন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিয়ে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দেশে নিয়ে যেতে চাইছে। ভারত যেখানে রবীন্দ্রনাথের ভাবধারায় একটি প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে চেয়েছে, সেখানে পাকিস্তান এখন জিন্নাহ বা আল্লামা ইকবালের মতাদর্শে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে দীক্ষিত করতে চাইছে, যা ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভাবের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

সব মিলিয়ে, যে বাংলাদেশ একসময় ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশী ছিল, সেই বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা নয়াদিল্লিতে একটি বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করেছে যে, এই নতুন সমীকরণ আগাগোড়াই ভারতের স্বার্থবিরোধী হতে চলেছে।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত