ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২
ইনসাইডার ট্রেডিং প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশ কোথায়?
সাইফুল ইসলাম পিপন:বাংলাদেশের শেয়ারবাজরে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বিনিয়োগকারীর আস্থার অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ইনসাইডার ট্রেডিং। আইনগতভাবে এটি অপরাধ হলেও বাস্তবে এর প্রতিরোধ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এখনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে অনেক পিছিয়ে। প্রশ্ন উঠছে —বৈশ্বিক শেয়ারবাজরগুলো যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং ও এনালিটিক্যাল মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে ইনসাইডার ট্রেডিং প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনো তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় বিলম্বে ভুগছে কেন?
ইনসাইডার ট্রেডিং কী ও কেন এটি ভয়ংকর অপরাধ
ইনসাইডার ট্রেডিং বলতে বোঝায় —কোনো কোম্পানির অভ্যন্তরীণ গোপন তথ্য ব্যবহার করে শেয়ার ক্রয় বা বিক্রয়ের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়া। যেমন- পরিচালক, শীর্ষ কর্মকর্তা, অডিটর বা কোনো অভ্যন্তরীণ তথ্যপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি বাজারে তথ্য প্রকাশের আগে ওই তথ্য ব্যবহার করে লেনদেন করে, তবে সেটিই ইনসাইডার ট্রেডিং। এটি বাজারে আস্থা ধ্বংস করে, ছোট বিনিয়োগকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং বাজারের ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটঃ কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি
উন্নত শেয়ারবাজরগুলোতে ইনসাইডার ট্রেডিং রোধে প্রযুক্তির ব্যবহারই মূল শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিস এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) প্রতিদিন হাজারো ট্রানজাকশন রিয়েল-টাইমে বিশ্লেষণ করে, যেখানে অ্যালগরিদম সন্দেহজনক লেনদেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করে। ২০২৩ সালে এসইসিইনসাইডার ট্রেডিং-সংক্রান্ত ৪৬টি মামলায় প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার জরিমানা আদায় করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথোরিটি (এফসিএ) ও সিঙ্গাপুরের মনিটরি অথোরিটি অফ সিঙ্গাপুর (এমএএস) নিয়মিতভাবে ট্রেডিং প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে, যেখানে এআই-ভিত্তিক “মার্কেট সার্ভিলেন্সসিস্টেম” ব্যবহার করা হয়।এই দেশগুলোতে ইনসাইডার ট্রেডিং কেবল আইনি অপরাধ নয়; এটি নৈতিক ও পেশাগত অযোগ্যতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা আজীবনের জন্য বাজার থেকে নিষিদ্ধ হন।
বাংলাদেশের আইন ও বাস্তবতা
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জঅর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (প্রহিবিশন অফ ইনসাইডার ট্রেডিং) রুলস, ১৯৯৫ অনুয়াযী বাংলাদেশে ইনসাইডার ট্রেডিং নিষিদ্ধ। তবে বাস্তবে এসব বিধান প্রয়োগে রয়েছে নানা দুর্বলতা।প্রথমত, সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্তের জন্য রিয়েল-টাইম পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি এখনো পর্যাপ্তভাবে ব্যবহৃত হয় না।দ্বিতীয়ত, তদন্তের গতি অত্যন্ত ধীর —অনেক সময় মামলা দায়ের থেকে রায় পর্যন্ত এক দশক লেগে যায়।তৃতীয়ত, শাস্তির মাত্রা আর্থিক অপরাধের তুলনায় খুবই কম; ফলে এটি ভীতি তৈরি করতে ব্যর্থ। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কয়েকটি কোম্পানির পরিচালকদের বিরুদ্ধে ইনসাইডার ট্রেডিং অভিযোগে তদন্ত শুরু করলেও, আদালতে এর রায় বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির এখনো বিরল।
তুলনামূলক চিত্রঃ আমরা কোথায় পিছিয়ে
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ভারত —এই তিনটি এশীয় উদাহরণ দেখায় কীভাবে উন্নয়নশীল অর্থনীতিও ইনসাইডার ট্রেডিং দমন করতে সক্ষম হয়েছে।ভারতের এসইবিআই ২০১৯ সালে “ইন্টিগ্রেটেড মার্কেট সার্ভিলেন্স সিস্টেম”চালু করে, যা প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ লেনদেন পর্যবেক্ষণ করতে পারে।সিঙ্গাপুরেএআই-ড্রিভেন এনোম্যালি ডিটেকশন সিস্টেম ব্যবহৃত হয়, যা সন্দেহজনক প্যাটার্ন শনাক্ত করে সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ট পাঠায় মনিটরিং টিমকে।অন্যদিকে, বাংলাদেশ এখনো মূলত মানব-নির্ভর ডেটা বিশ্লেষণ ও পরবর্তী তদন্তের ওপর নির্ভর করছে —যা সময়সাপেক্ষ ও কার্যতঃ অকার্যকর।
কী করা যেতে পারে
বাংলাদেশে ইনসাইডার ট্রেডিং প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে কিছু নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন—
১. রিয়েল-টাইম ট্রেডিং মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে হবে, যাতে অ্যালগরিদম সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করতে পারে।
২. ইনসাইডার ট্রেডিং সংক্রান্ত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা দরকার, যাতে বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হয়।
৩. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে,যেমন-“ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ সিকিউরিটিজ কমিশন” -এর গাইডলাইন অনুসরণ করে একটি কোড অব কনডাক্ট প্রণয়ন।
৪. তথ্যপ্রযুক্তি ও ডেটা অ্যানালিটিকস প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।
৫. জনসচেতনতা ও নৈতিক মান উন্নয়ন করতে হবে, যাতে কোম্পানির পরিচালক ও কর্মকর্তারা আইন ভাঙার আগে নৈতিকভাবে বিরত থাকেন।
শেয়ারবাজরের আস্থার মূল শর্তই হলো ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা।যে দেশে ইনসাইডার ট্রেডিং দমন করা যায়নি, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থায়ীভাবে আস্থা রাখতে পারে না।বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক মানের শেয়ারবাজরে পরিণত হতে চায়, তবে প্রযুক্তি, নীতি ও নৈতিকতার সমন্বয়ে ইনসাইডার ট্রেডিং প্রতিরোধকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।অন্যথায়,এই অদৃশ্য কিন্তু ভয়ংকর অপরাধ যদি সময়মতো নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে তা ধীরে ধীরে বাজারের ভিত ক্ষয় করবে, বিনিয়োগকারীর আস্থা নষ্ট করবে, আর আমাদের স্বপ্নের ‘ডিজিটাল ক্যাপিটাল মার্কেট’হয়তো কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
লেখক একজন শেয়ারবাজার বিশ্লেষক।
শেয়ারবাজারের বিশ্লেষণ ও ইনসাইড স্টোরি পেতে আমাদের পেজ ফলো করুন।
পাঠকের মতামত:
সর্বোচ্চ পঠিত
- ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা: টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি সরাসরি দেখুন (LIVE)
- বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান: ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ-খেলাটি সরাসরি দেখুন (LIVE)
- শনিবারের ঢাবি বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত
- ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি আর নেই
- ঢাবির বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কবে? জানানো হলো নতুন তারিখ
- জায়ান্টস বনাম এমিরেটস: বোলিংয়ে সাকিব-দেখুন সরাসরি (LIVE)
- আবু ধাবি নাইট রাইডার্স বনাম শারজাহ ওয়ারিয়র্জ: বোলিংয়ে তাসকিন-দেখুন সরাসরি (LIVE)
- মেলবোর্ন স্টারস বনাম হোবার্ট হারিকেন: ম্যাচটি শেষ-দেখে নিন ফলাফল
- ভারত-পাকিস্তানের জমজমাট ফাইনাল ম্যাচটি শেষ-দেখে নিন ফলাফল
- স্থগিত হওয়া ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যা বলছে ঢাবির কর্তৃপক্ষ
- আজকের বাজারে স্বর্ণের দাম (২০ ডিসেম্বর)
- এবার প্রকাশ্যে এনসিপি নেতা মোতালেব গুলিবিদ্ধ
- শারজাহ ওয়ারিয়র্স বনাম দুবাই ক্যাপিটালস: ব্যাটিংয়ে মুস্তাফিজরা-সরাসরি দেখুন
- প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় থাকছে বুয়েটের প্রযুক্তি
- ব্লুমবার্গের তালিকায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজার কোম্পানির বড় লাফ