ঢাকা, রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ৪ কার্তিক ১৪৩২

ভূমধ্যসাগরে প্রাণের লড়াই,সেউটায় মা-সন্তানের ভয়াবহ যাত্রা

২০২৫ অক্টোবর ১৯ ১৬:৩৭:২৮

ভূমধ্যসাগরে প্রাণের লড়াই,সেউটায় মা-সন্তানের ভয়াবহ যাত্রা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :মরক্কোর এক মা ও তার ১০ বছর বয়সী সন্তান ভূমধ্যসাগরের উত্তাল স্রোত পাড়ি দিয়ে স্পেনের ছিটমহল সেউটায় পৌঁছেছেন। গত সপ্তাহে সংঘটিত এই দুঃসাহসিক ঘটনা মরক্কো ও স্পেনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তাদের এই বিপজ্জনক যাত্রা আলো ফেলে দিয়েছে উত্তর আফ্রিকার দেশটির ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের ওপর।

মরক্কোর ফনিদেক শহর থেকে গত ১২ অক্টোবর ডাইভিং স্যুট ও পায়ে ফিন পরে সাগরে নামেন মা ও ছেলে। কয়েক ঘণ্টা ধরে ভয়াবহ ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে তারা পৌঁছান সেউটার উপকূলে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘এল ফারো দে সেউটা’ প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, ছোট্ট শিশু একটি ভাসমান বোর্ড আঁকড়ে ধরে আছে, আর তার পাশে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত এক নারী—তার মা। তীরে উপস্থিত লোকজন বিস্ময়ের সঙ্গে এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন।

তীরে পৌঁছানোর পর স্পেনের সিভিল গার্ড সদস্যরা মা ও সন্তানকে উদ্ধার করে। তৎক্ষণাৎ তাদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা পরীক্ষা করা হয়। পরে তাদের সেউটার শরণার্থী গ্রহণকেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। উদ্ধারকারীদের মতে, এই যাত্রা ছিল চরম ঝুঁকিপূর্ণ ও জীবনহানিকর।

বর্তমানে মরক্কোর সামগ্রিক বেকারত্বের হার ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে এই হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। চাকরির অভাব, নিম্নমানের জীবনযাত্রা ও সামাজিক বৈষম্যের ফলে বহু মরক্কোবাসী ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেউটায় বেড়া ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আরও কড়াকড়ি করা হয়েছে। ফলে অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাঁতারের মাধ্যমে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করছেন।

এই পথে মৃত্যুও খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০ জন মরক্কোর নাগরিক সেউটায় সাঁতার কেটে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। গত বছর ১৯ বছর বয়সী তরুণী ছাইমা এল গ্রিনি একই পথে পাড়ি দিতে গিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। সামাজিক মাধ্যমে তিনি লিখেছিলেন, “স্রোত আমাকে পাথরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। যারা নিজেরা চেষ্টা করেননি, তারা বুঝতে পারবেন না এটি কতটা কঠিন।”

অর্থনৈতিক দুরবস্থার পাশাপাশি মরক্কো জুড়ে চলছে ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতা। সেপ্টেম্বরের শেষদিক থেকে দেশজুড়ে শিক্ষাগত সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা ও সম্মানজনক জীবনের দাবিতে তরুণদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ‘জেন জি ২১২’ নামের একটি যুব সংগঠনের ডাকে শত শত তরুণ রাস্তায় নেমে নিজেদের ভবিষ্যতের দাবি জানাচ্ছেন।

এই প্রেক্ষাপটে এখন শুধু পুরুষই নয়, নারীরাও মরিয়া হয়ে ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নিচ্ছেন। গবেষক আলী জুবাইদি বলেন, এই নারী অভিবাসীরা মরক্কোর সমাজে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিতে ধাক্কা দিচ্ছেন। কারণ, এতদিন সেউটায় সাঁতার কেটে পৌঁছানোকে পুরুষদের সাহস ও শক্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু এখন নারীরাও দেখাচ্ছেন, সংকট মোকাবেলায় তারাও সমানভাবে দৃঢ় ও সক্ষম।

সেউটায় এই মা-সন্তানের প্রবেশ শুধুই একটি ব্যক্তিগত গল্প নয়, বরং এটি মরক্কোর গভীরতর আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন। উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছাড়ছেন অসংখ্য মানুষ—যাদের সামনে সমুদ্রের ভয় নয়, বরং জীবনের অনিশ্চয়তা বড় হয়ে উঠেছে।

ডুয়া/নয়ন

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত