ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর ২০২৫, ১৭ আশ্বিন ১৪৩২

শেয়ারবাজারে ৩১ ব্যাংকের লোকসান সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা

আবু তাহের নয়ন
আবু তাহের নয়ন

সিনিয়র রিপোর্টার

২০২৫ অক্টোবর ০২ ১৪:৩০:৫৮

শেয়ারবাজারে ৩১ ব্যাংকের লোকসান সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা

আবু তাহের নয়ন: দেশের শেয়ারবাজারের জন্য ২০২৪ সাল ছিল ভয়াবহ মন্দার বছর। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো ব্যাংকগুলোকেও এই সময়ে গুনতে হয়েছে বিপুল অঙ্কের লোকসান। প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়—এমন মোট ৩৪ ব্যাংকের মধ্যে ৩১টি ব্যাংকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ব্যাংকের লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকায়।

অন্যদিকে মুনাফা করতে পেরেছে মাত্র তিনটি ব্যাংক, যার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে কেবল ২৩ কোটি টাকা—যা লোকসানের তুলনায় নগণ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, সব ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ হিসাব একত্র করা গেলে লোকসানের পরিমাণ আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরবে।

বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ লোকসানের পেছনে মূলত ব্যাংক পরিচালনাকারীদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, বিনিয়োগে তহবিলের সঠিক ব্যবহার না হওয়া, ফ্লোর প্রাইসের কারণে সময়মতো শেয়ার বিক্রি করতে না পারা এবং জাঙ্ক শেয়ারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগই প্রধান কারণ। তাদের মতে, ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে কার্যকর কৌশল নিতে ব্যর্থ হয়েছে, ঠিক যেমন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা করেছেন।

শেয়ারবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য অধ্যাপক আল-আমিন এ বিষয়ে বলেন, “গত কয়েক বছরে কোনো ক্ষেত্রেই সুশাসন ছিল না। অনেক ব্রোকারেজ হাউস ও ব্যাংক অনিয়ম করেছে। এমনকি আইসিবির মতো প্রতিষ্ঠানও ফরচুনের শেয়ারে বিনিয়োগ করে বড় লোকসান করেছে। তাই ব্যাংকগুলোর ক্ষতির পেছনে অনিয়ম ও গুড গভর্ন্যান্সের অভাবকেই দায়ী করা যায়।”

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, লোকসান করা ৩১ ব্যাংকের মোট লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে শীর্ষে জনতা ব্যাংক, যার লোকসান ৪০০ কোটি টাকা। এরপর আছে সোনালী ব্যাংক (৩৯৮ কোটি), ইস্টার্ন ব্যাংক (৩৫৩ কোটি), সাউথইস্ট ব্যাংক (৩২৬ কোটি) এবং এবি ব্যাংক (২৬১ কোটি)। শুধু এই পাঁচ ব্যাংকেই লোকসানের অঙ্ক ১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।

অন্যদিকে বাকি ২৬ ব্যাংকের লোকসান হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ২২৮ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ২১৭ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ২১৬ কোটি, উত্তরা ব্যাংক ১৭২ কোটি, এনসিসি ব্যাংক ১৬৫ কোটি, রূপালী ব্যাংক ১৫৩ কোটি, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ১৩৩ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ১০৭ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংক ৮৩ কোটি, এসবিএসি ব্যাংক ৬৪ কোটি, এনআরবি ব্যাংক ৫৫ কোটি, পূবালী ব্যাংক ৪৮ কোটি, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ৪৬ কোটি, ইউসিবি ৩৩ কোটি, বেসিক ব্যাংক ৩১ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৩০ কোটি, ব্যাংক এশিয়া ২৩ কোটি, সিটি ব্যাংক ১৯ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ১৪ কোটি, এমটিবি ১৩ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১৩ কোটি, মেঘনা ব্যাংক ১০ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংক ৯ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৭ কোটি, যমুনা ব্যাংক ১.৫ কোটি এবং ঢাকা ব্যাংক ১ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিপরীতে মাত্র তিনটি ব্যাংক মুনাফা করেছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১২ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংক ৭ কোটি এবং প্রাইম ব্যাংক ৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। তিন ব্যাংকের সম্মিলিত মুনাফা ২৩ কোটি টাকা হলেও তা লোকসানের তুলনায় তা নগণ্য।

সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বলেছেন, “ফ্লোর প্রাইসের কারণে সময়মতো শেয়ার বিক্রি করা যায়নি। ডিলার অ্যাকাউন্ট, কাস্টমার অ্যাকাউন্ট—দুটো ক্ষেত্রেই সমস্যা হয়েছে। মার্জিন লোনও সমন্বয় করা যায়নি। প্রায় ৪০০ কোটি টাকার লোন ব্লক হয়ে ছিল। এর ওপর সুদ আর ম্যানেজমেন্ট খরচ চেপেছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও প্রভাব ফেলেছে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর বড় ক্ষতির কারণ জাঙ্ক শেয়ারে বিনিয়োগ। বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক বন্ডে অনেক ব্যাংক বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২৪ সালে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বেক্সিমকো গ্রুপের মালিক সালমান এফ রহমান কারাগারে গেলে শেয়ারের দাম অর্ধেক নেমে আসে। এছাড়া আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও পিপলস লিজিংয়ের মতো সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানেও ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ধসে নেমেছে ১ হাজার ২৬ পয়েন্ট বা প্রায় ১৬ শতাংশ। এ সময়ে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের মন্দা বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি ব্যাংক খাতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে বাজারের এই ধাক্কা সামলাতে ব্যাংকগুলোকে দক্ষতা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বাড়তি কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। যদিও অধিকাংশ ব্যাংক লোকসানে গেছে, তবু সীমিত সংখ্যক ব্যাংক মুনাফা ধরে রাখতে পেরেছে—যা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও খাতটির টিকে থাকার সক্ষমতার প্রমাণ।

এএসএম/

শেয়ারবাজারের বিশ্লেষণ ও ইনসাইড স্টোরি পেতে আমাদের পেজ ফলো করুন।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত