ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২

১৬ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে তারেক রহমান যা বললেন

২০২৫ ডিসেম্বর ২৫ ১৯:৫৭:৩৮

১৬ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে তারেক রহমান যা বললেন

নিজস্ব প্রতিবেদক: দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে প্রিয় জন্মভূমির মাটিতে পা রেখেই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা শোনালেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর ৩০০ ফিট (৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়ে) এলাকায় আয়োজিত বিশাল গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রায় ১৬ মিনিটের এক আবেগঘন বক্তব্যে তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেন।

তারেক রহমানের দেয়া পূর্ণাঙ্গ ভাষণটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো:

‘প্রিয় ভাই-বোনেরা, প্রিয় মা-বোনেরা আসসালামু আলাইকুম। আজ প্রথমেই আমি রাব্বুল আলামিনের দরবারে হাজারো-লক্ষ-কোটি শুকরিয়া জানাতে চাই রাব্বুল আলামিনের দরবারে। তার অশেষ রহমতে আজ আমি আমার প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পেরেছি আপনাদের দোয়ায় আপনাদের মাঝে।

আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি ১৯৭১ সালে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল। ঠিক একইভাবে ৭৫-এ আবার ৭ই নভেম্বর আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য সেদিন সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে আধিপত্যবাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা হয়েছিল। একইভাবে পরবর্তীতে ৯০-এ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এ দেশের জনগণ, এ দেশের খেটেখাওয়া মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ছিনিয়ে এনেছিল। কিন্তু তারপরেও ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। আমরা তারপর দেখেছি ২০২৪ সাল।

’৭১ সালে এই দেশের মানুষ যেমন স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, এ দেশের ছাত্র-জনতাসহ সর্বস্তরের মানুষ কৃষক-শ্রমিক-গৃহবধূ, নারী-পুরুষ, মাদরাসার ছাত্রসহ দল-মত, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এই দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছিল।

প্রিয় ভাই-বোনেরা আজ বাংলাদেশের মানুষ কথা বলার অধিকার ফিরে পেতে চায়। তারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে চায়। বাংলাদেশের মানুষ চায়–তারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য অধিকার পাবে। প্রিয় ভাই-বোনেরা, আজ আমাদের সময় এসেছে সবাই মিলে দেশ গড়ার।

এই দেশে যেমন পাহাড়ের মানুষ আছে এই দেশে একইভাবে সমতলের মানুষ আছে। এই দেশে মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে। আমরা চাই সবাই মিলে এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলব, যেই বাংলাদেশের স্বপ্ন একজন মা দেখেন। অর্থাৎ একটি নিরাপদ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলাদেশে একজন নারী, একজন পুরুষ, একজন শিশু যে-ই হোক না কেন ঘর থেকে বের হলে যেন নিরাপদে আবারও ঘরে ফিরে আসতে পারে।

প্রিয় ভাই-বোনেরা, এই দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, ৪ কোটিরও বেশি তরুণ প্রজন্মের সদস্য, পাঁচ কোটির মতো শিশু। ৪০ লাখের মতো প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছেন, রয়েছেন কয়েক কোটি কৃষক-শ্রমিক। এই মানুষগুলোর একটি প্রত্যাশা আছে এই রাষ্ট্রের কাছে। এই মানুষগুলোর একটি আকাঙ্ক্ষা আছে এই দেশের কাছে। আজ আমরা সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ হই, আজ আমরা যদি সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই–তাহলে আমরা এই লক্ষ কোটি মানুষের সেই প্রত্যাশাগুলো পূরণ করতে পারব ইনশাআল্লাহ। প্রিয় ভাই-বোনেরা, ’৭১ সালে আমাদের শহীদরা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এইরকম একটি বাংলাদেশ গঠনের জন্য।

বিগত ১৫ বছরে শত শত হাজারো গুম খুনের শিকার হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়, নিরীহ মানুষও প্রতিবাদ করতে গিয়ে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছে, জীবন দিয়েছে। ২০২৪ সাল মাত্র সেদিনের ঘটনা। আমরা দেখেছি আমাদের তরুণ প্রজন্মের সদস্যরা কীভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে দেশের এই স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য। প্রিয় ভাই-বোনেরা কয়েকদিন আগে এই বাংলাদেশের ২৪-এর আন্দোলনের এক সাহসী সদস্য ওসমান হাদিকে হত্যা করা হয়েছে। ওসমান হাদি শহীদ হয়েছে। প্রিয় ভাই-বোনেরা, ওসমান হাদি চেয়েছিল এই দেশের মানুষের জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। এই দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। এই দেশের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার ফিরে পাক।

আজ ২৪-এর আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, ওসমান হাদিসসহ ৭১ এ যারা শহীদ হয়েছেন, বিগত স্বৈরাচারের সময় বিভিন্নভাবে গুম-খুনের শিকার হয়েছেন, এই মানুষগুলোর রক্তের ঋণ যদি শোধ করতে হয়; আসুন আমরা আমাদের সেই প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলব। যেখানে আমরা সবাই মিলে কাজ করব, যেখানে আমরা সবাই মিলে আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশকে গড়ে তুলব। প্রিয় ভাই-বোনেরা, বিভিন্ন আধিপত্যবাদ শক্তির গুপ্তচরেরা বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্রে এখন লিপ্ত রয়েছে। আমাদেরকে ধৈর্যশীল হতে হবে। আমাদেরকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের যে সদস্যরা আছেন আপনারাই আগামী দিন দেশকে নেতৃত্ব দেবেন, দেশকে গড়ে তুলবেন, এই দায়িত্ব তরুণ প্রজন্মের সদস্যদেরকে আজ গ্রহণ করতে হবে, যাতে করে এই দেশকে আমরা সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারি। শক্ত ভিত্তির ওপরে গণতান্ত্রিক ভিত্তি, শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপরে যাতে এই দেশকে আমরা গড়ে তুলতে পারি। প্রিয় ভাই-বোনেরা, আমার সঙ্গে আজকে মঞ্চে এখানে বহু জাতীয় নেতৃবৃন্দ বসে আছেন। আসুন আজকে আমরা দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে দোয়া করি। আল্লাহর রহমত আমরা চাই। যেসব জাতীয় নেতৃবৃন্দ এই মঞ্চে আছেন, মঞ্চের বাইরে যেসব জাতীয় আরো নেতৃবৃন্দ আছেন, আমরা সবাই মিলে এই দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশিত সেই বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলতে চাই।

যেকোনো মূল্যে আমাদেরকে এই দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। যেকোনো উসকানির মুখে আমাদেরকে ধীর-শান্ত থাকতে হবে। প্রিয় ভাই-বোনেরা, আমরা দেশে শান্তি চাই। ভাই-বোনেরা, মার্টিন লুথার কিং নাম শুনেছেন না? তার একটি বিখ্যাত ডায়ালগ আছে–আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম। আজ এই বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আপনাদের সবার সামনে আমি বলতে চাই–বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন সদস্য হিসাবে আপনাদের সামনে আমি বলতে চাই, আই হ্যাভ আ প্ল্যান ফর দ্য পিপল, অব মাই কান্ট্রি, ফর মাই কান্ট্রি। আজ এই পরিকল্পনা দেশের মানুষের স্বার্থে, দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য। যদি সেই প্ল্যান সেই কার্যক্রম সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে হয়–প্রিয় ভাই-বোনেরা, এই জনসমুদ্রে যত মানুষ উপস্থিত আছেন, এই সারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের শক্তি যত মানুষ উপস্থিত আছেন প্রত্যেকটি মানুষের সহযোগিতা আমার লাগবে।

আপনারা যদি আমাদের পাশে থাকেন আপনারা যদি আমাদেরকে সহযোগিতা করেন, ইনশাআল্লাহ আমরা এ প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব। আসুন আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করি–হে রাব্বুল আলামিন, হে একমাত্র মালিক, হে একমাত্র পরওয়ারদিগার, হে একমাত্র রহমত দানকারী, হে একমাত্র সাহায্যকারী আজ আপনি যদি আমাদেরকে রহমত দান করেন, তাহলে আমরা এই দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রম করার মাধ্যমে আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশকে গড়ে তুলব।

আজ যদি আল্লাহর রহমত এই দেশ এবং এই দেশের মানুষের পক্ষে থাকে, আল্লাহর সাহায্য আল্লাহর দয়া এই দেশের মানুষের ওপরে–এই দেশের ওপরে থাকে ইনশাআল্লাহ আমরা আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব। প্রিয় ভাই-বোনেরা, আজ আসুন আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি যে, ইনশাআল্লাহ আগামী দিনে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যারা আসবে আমরা সবাই নবী করিম (সা.) যে ন্যায়পরায়ণ, সেই ন্যায়পরায়ণতার আলোকে দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

প্রিয় ভাই-বোনেরা, আজ আপনারা জানেন এখান থেকে আমি আমার মা দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে যাব। একটি মানুষ যে মানুষটি এই দেশের মাটি এই দেশের মানুষকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসেছেন। তার সঙ্গে কি হয়েছে আপনারা প্রত্যেকটি মানুষ সে সম্পর্কে অবগত আছেন। সন্তান হিসাবে আপনাদের কাছে আমি চাইব আজ আল্লাহর দরবারে আপনারা দোয়া করবেন যাতে আল্লাহ উনাকে তৌফিক দেন উনি যাতে সুস্থ হতে পারেন। প্রিয় ভাই-বোনেরা, সন্তান হিসেবে আমার মন আমার মায়ের বিছানার পাশে পড়ে আছে, সেই হাসপাতালের ঘরে। কিন্তু সেই মানুষটি যাদেরকে যাদের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছে অর্থাৎ আপনারা। যাদের জন্য দেশনেত্রী খালেদা জিয়া জীবন উৎসর্গ করেছেন নিজের জীবন, সেই মানুষগুলোকে আমি কোনোভাবেই ফেলে যেতে পারি না এবং সেজন্যই আজ হাসপাতালে যাওয়ারর আগে আপনাদের প্রতিসহ টেলিভিশনগুলোর মাধ্যমে যারা সমগ্র বাংলাদেশে আমাকে দেখছেন আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য এখানে দাঁড়িয়েছি আপনাদের সামনে।

প্রিয় ভাই-বোনেরা, আসুন আমাদেরকে আজকে নিশ্চিত করতে হবে আমরা যে ধর্মের মানুষ হই, আমরা যে শ্রেণির মানুষ হই, আমরা যে দলেরই সদস্য হই, অথবা একজন নির্দলীয় ব্যক্তি হই। আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যেকোনো মূল্যে আমরা আমাদের এই দেশের শান্তি-শৃঙ্খলাকে ধরে রাখতে হবে, যেকোনো মূল্যে যেকোনো বিশৃঙ্খলাকে পরিত্যাগ করতে হবে, যেকোনো মূল্যে আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে–যাতে মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে। শিশু হোক নারী হোক পুরুষ হোক–যেকোনো বয়স যেকোনো শ্রেণি, যেকোনো পেশা, যেকোনো ধর্মের মানুষ যেন নিরাপদ থাকে এই হোক আমাদের চাওয়া।

আজকে প্রিয় ভাই-বোনেরা আসুন সবাই মিলে আজ আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, সবাই মিলে করব কাজ। ইনশাআল্লাহ আপনাদের সবার কাছে দোয়া চেয়ে আবারও সবাইকে যেকোনো মূল্যে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার আহ্বান জানিয়ে যেকোনো বিশৃঙ্খলাকে পরিহার করে ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি। আবারও আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আজকে আমাকে এভাবে বরণ করে নেওয়ার জন্য। আল্লাহ হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জিন্দাবাদ। আসসালামু আলাইকুম।’

এসপি

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত