ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০ আশ্বিন ১৪৩২

আমদানি বাড়লেও পণ্যের দাম কেন কমছে না?

২০২৫ সেপ্টেম্বর ২৬ ০১:৩০:৫৩

আমদানি বাড়লেও পণ্যের দাম কেন কমছে না?

নিজস্ব প্রতিবেদক: চলতি বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশের আমদানি তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে না আসায় তাদের দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে দেশে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ৬.২ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৯.৫ শতাংশ বেশি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠা, আমদানি নীতির শিথিলকরণ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার পর স্বাভাবিক ব্যবসার পুনরাবির্ভাব এই আমদানি বৃদ্ধির মূল কারণ। গত বছর জুলাইয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বন্দর কার্যক্রমে ব্যাঘাতের কারণে আমদানি কমে গিয়েছিল। তবে এবারের আমদানি বৃদ্ধিকে অর্থনীতিবিদরা প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হিসেবে দেখছেন না।

পিপিআরসি’র সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ মানুষ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন। প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ এখনও আর্থিক সংকটে রয়েছেন, যেখানে ৬৭ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় এবং ২৭ শতাংশ ঋণ পরিশোধ নিয়ে সমস্যায় ভুগছেন। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, "একশ্রেণির ব্যবসায়ী বছরের পর বছর মূল্য কারসাজি করে ক্রেতাকে ঠকাচ্ছেন। সরকারের স্থায়ী পদক্ষেপ বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেই। তদারকি কার্যকর নয়।"

নিত্যপণ্য যেমন চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, সবজি, মাছ-মাংস— সবকিছুর দামই ঊর্ধ্বমুখী। একসময় মাসের শুরুতে একসঙ্গে বাজার করা পরিবারগুলো এখন সপ্তাহে ভাগ করে বাজার করছে এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম কিনে কোনোমতে টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছে। মধ্যবিত্তের ভোজন তালিকা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে, দাওয়াত বা মেহমানদারি এখন বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসা, শিক্ষা, যাতায়াত— সব খাতেই নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্যের প্রভাব পড়ছে।

সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহিয়া জুনেদ বলেন, "শিল্প খাতে চাহিদা ফের বেড়ে যাওয়াই এ বছরের আমদানি বৃদ্ধির মূল কারণ। এটি সাধারণ মানুষের ক্রয়শক্তি বৃদ্ধির কারণে নয়, বরং উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের জন্য।" ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কামরান টি রহমানও একই মত পোষণ করে বলেন, "মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে। তবে এটি প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং ব্যবসা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার প্রতিফলন।"

জুলাইয়ে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি বেড়েছে। মধ্যবর্তী পণ্য (যার মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামালও আছে) ৩.৮৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২১ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ৪৫৬ মিলিয়ন ডলার, যা ৭১ শতাংশ বৃদ্ধি। পোশাক-সংক্রান্ত কাঁচামাল ১.৫২ বিলিয়ন ডলার, যা ১০.৩ শতাংশ বৃদ্ধি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা কিছু কারখানায় গ্যাস সংযোগ পাওয়ার পর উৎপাদন শুরু হওয়ায় আমদানির পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর শীর্ষ ২০ ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ব্যবসায়ীরা তাতে নিত্যপণ্যের আমদানি সহজ করার দাবি তোলেন। মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, "আমদানির বাধা কমালে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।" নাবিল গ্রুপের এমডি আমিনুল ইসলাম স্বপন বলেন, "বাজার স্থিতিশীল রাখতে গভর্নর যেকোনো সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।"

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তিন বছরের (২০২৫-২৮) জন্য নতুন আমদানি নীতি প্রণয়ন করছে, যেখানে ন্যূনতম দর বা নগদ মার্জিনের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। যেকোনও আমদানিকারক যেকোনও পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে পারবেন। এলডিসি থেকে বের হওয়ার সময়কাল এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি মাথায় রাখা হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদিও আমদানির পরিমাণ বেড়েছে, ভোক্তা বাজারে চাহিদা সীমিত ও ঋণপত্রের উচ্চ সুদহার থাকায় পণ্যের দাম স্থিতিশীল হচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এবং জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে না আসায় মূল্যস্ফীতি এখনও দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

এসপি

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

সর্বোচ্চ পঠিত