ঢাকা, রবিবার, ৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিতর্কে ধর্মীয় স্বাধীনতা, যুক্তরাজ্যে মুসলমানদের উদ্বেগ বাড়ছে

ডুয়া নিউজ- আন্তর্জাতিক
২০২৫ জুন ০৮ ২০:১৭:২৬
বিতর্কে ধর্মীয় স্বাধীনতা, যুক্তরাজ্যে মুসলমানদের উদ্বেগ বাড়ছে

মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষঙ্গ—হালাল মাংস ও বোরকা—আবারও যুক্তরাজ্যের মূলধারার রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছে। সম্প্রতি এসব বিষয় নিয়ে শুরু হওয়া রাজনৈতিক আলোচনা দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

হালাল ও বোরকা বহুদিন ধরেই যুক্তরাজ্যের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। তবে রাজনৈতিক বিভাজন ও প্রচারণা এখন এই প্রথাগুলোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মুসলমানদের আশঙ্কা, বারবার ধর্মীয় অধিকারগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে চ্যালেঞ্জ জানানো হলে, তা কেবল একটি সম্প্রদায়ের নয়, পুরো ব্রিটিশ গণতন্ত্রের সহনশীলতার ওপরই আঘাত হানবে।

ধর্মীয় স্বাধীনতা বনাম পশু কল্যাণআগামী সোমবার (৯ জুন ২০২৫) হাউজ অব কমন্সে একটি গুরুত্বপূর্ণ ই-পিটিশনের ওপর বিতর্ক হবে। এতে অজ্ঞান না করে পশু জবাই নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়েছে—যা সরাসরি হালাল ও শেচিতা প্রথার ওপর প্রভাব ফেলবে। ইতোমধ্যেই পিটিশনটিতে এক লাখের বেশি মানুষ স্বাক্ষর করেছেন।

বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ধর্মীয় কারণে কিছু নির্দিষ্ট জবাই-পদ্ধতির অনুমতি থাকলেও পশু অধিকারকর্মীরা তা নিষ্ঠুর বলেই মনে করছেন। ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের সাম্প্রতিক রায়ও এমন জবাই নিষিদ্ধকে ধর্মীয় অধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে দেখেনি।

তবে পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যের ৮৮ শতাংশ হালাল মুরগি ও অধিকাংশ গরু অজ্ঞান করেই জবাই হয়—ইসলামী বিধানের সীমার মধ্যেই। সরকারের অবস্থান হলো, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও পশু কল্যাণের মধ্যে ভারসাম্য রাখা।

সম্প্রতি হালাল মাংস নিয়ে বাজারে প্রতারণার অভিযোগও উঠেছে। কার্ডিফে এক ব্যবসায়ী হালাল নামে ভুয়া মাংস বিক্রির দায়ে দণ্ডিত হন। ফলে জবাই-পদ্ধতির লেবেলিং বাধ্যতামূলক করার দাবিও জোরালো হচ্ছে।

বোরকা বিতর্ক ও রাজনৈতিক অবস্থানবোরকা নিষিদ্ধ করার দাবি তুলে বিতর্কের সূত্রপাত করেছে ডানপন্থি রিফর্ম ইউকে পার্টি। ইউরোপের কিছু দেশের নজির টেনে তারা যুক্তরাজ্যেও মুখঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানায়। এই ইস্যুতে দলের ভেতর বিভাজন তৈরি হয় এবং দলীয় চেয়ারম্যান জিয়া ইউসুফ পদত্যাগ করেন, যদিও পরে তিনি দলে ফিরে আসেন।

নাইজেল ফারাজ ও লি অ্যান্ডারসনের মতো নেতারা নিরাপত্তার যুক্তিতে মুখ খোলা রাখার পক্ষ নিচ্ছেন। কনজারভেটিভদের মধ্যেও এমন মত রয়েছে। তবে লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার স্পষ্ট করেছেন, তারা ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত পছন্দে হস্তক্ষেপ সমর্থন করেন না।

ধর্মীয় অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, নারীর পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা খর্ব করা অসাংবিধানিক এবং এটি ইসলামভীতি ও বৈষম্যকে উৎসাহিত করতে পারে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না সহনশীলতা প্রশ্ন?যুক্তরাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা মনে করছেন, এই বিতর্কগুলো মূলত রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তোলা হচ্ছে। বিশেষ করে রিফর্ম ইউকের মতো দলগুলো ভোটব্যাংক টার্গেট করে মুসলিম পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব ইস্যু তুলে ধরে বহুসংস্কৃতিবাদকে চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে। হালাল মনিটরিং কমিটি (এইচএমসি) অভিযোগ করেছে, অজ্ঞান না করে জবাই নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে মুসলমানদের বদনাম করার চেষ্টা হচ্ছে।

মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা ও উদ্বেগযুক্তরাজ্যে মুসলমানরা বর্তমানে দেশের অন্যতম বড় সংখ্যালঘু। ২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, এদের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ (জনসংখ্যার ৬ শতাংশ)। অধিকাংশই ব্রিটেনে জন্মেছেন এবং নিজেদের ব্রিটিশ পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

ব্রিটিশ বাংলাদেশি, পাকিস্তানি ও ভারতীয় মুসলমানরা হালাল ও বোরকা নিয়ে বিতর্ককে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। দীর্ঘদিনের চর্চিত প্রথাগুলো নিয়ে নতুন করে সন্দেহ তৈরি করাটা তাঁদের প্রজন্মগত বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ইসলামভীতি ও বৈষম্যের বাস্তবতামুসলিম অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিটেন (MAB) জানিয়েছে, ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে ডানপন্থি উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের পর ইসলামভীতি নতুন করে বেড়েছে।

গবেষণাগুলো দেখাচ্ছে, দক্ষিণ এশীয় ও আফ্রিকান মুসলিমরা কর্মসংস্থান, বাসস্থান ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। এর সঙ্গে দারিদ্র্যের সরাসরি সম্পর্ক আছে। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ৩৯ শতাংশ মুসলিম দরিদ্রতম এলাকায় বাস করেন—যা প্রায়শই জাতিগতভাবে ঘনবসতিপূর্ণ।

হালাল মাংস ও বোরকা নিয়ে যুক্তরাজ্যের বর্তমান বিতর্ক যেন কেবল ধর্মীয় প্রথা নিয়ে নয়, বরং ধর্মীয় স্বাধীনতা, সহনশীলতা ও বহুসংস্কৃতির চেতনার ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। এ বিতর্কে মুসলিমদের উদ্বেগ শুধু তাদের পরিচয় রক্ষার নয়—এটি ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক ভবিষ্যতের দিকেও ইঙ্গিত করে।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত