ঢাকা, শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

গুমের ঘটনায় প্রধান ভূমিকা ৪ বাহিনীর: তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন

ডুয়া নিউজ- জাতীয়
২০২৫ জুন ০৫ ১৯:১৭:০৫
গুমের ঘটনায় প্রধান ভূমিকা ৪ বাহিনীর: তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন

দেশে সংঘটিত বেশিরভাগ গুমের পেছনে পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি এবং সিটিটিসি জড়িত ছিল। গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেছেন।

এ ছাড়া পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন ইউনিটের বিরুদ্ধে গুমে প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে এসেছে। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের বিরুদ্ধেও গুমে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ডিজিএফআই এবং এনএসআই মূলত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের কাজে নিয়োজিত। তবে, আইনি বিধান অনুযায়ী তাদের কারও গ্রেপ্তার বা আটক করার ক্ষমতা নেই। তবুও এসব সংস্থার সদস্যরা যেভাবে ব্যক্তি আটক, অপহরণ এবং জিজ্ঞাসাবাদ পরিচালনা করেছে, তা সংবিধান ও আইনগত সীমা লঙ্ঘনের সামিল। এই পরিস্থিতি দেশের প্রচলিত আইন ব্যবস্থার বাইরে একটি সমান্তরাল ও বেআইনি ক্ষমতার বলয় গড়ে ওঠার আশঙ্কার ইঙ্গিত দেয়।

‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: অ্যা স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনটি ৪ জুন, বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত প্রতিটি বাহিনীর ভূমিকা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

পুলিশের ভূমিকাবাংলাদেশ পুলিশের কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। এটি দেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, অপরাধ দমন ও তদন্ত পরিচালনা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের মূল দায়িত্ব।

বাহিনীর বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিটের মধ্যে রয়েছে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি), স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে ওঠা এই বাহিনী স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে। তবে বিশেষ করে আ’ লীগ সরকারের শাসনামলে (২০০৯ সালের পর) পুলিশের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, হেফাজতে নির্যাতন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ বাড়তে থাকে।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালের পর থেকে পুলিশ একটি নিরপেক্ষ জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারপন্থি ‘এনফোর্সার’ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। সে সময় বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর ঘটনা ব্যাপক আকার নেয়। বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে উদ্বেগ দেখা দেয়।

‘ক্রসফায়ার’ নামে পরিচিত বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। এসব ঘটনায় কোনো বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতো না। হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের ওপর ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যায়। ভুক্তভোগীরা মারধর, বৈদ্যুতিক শক, পানিতে চুবিয়ে রাখা এবং অন্যান্য শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। যদিও ২০১৩ সালে ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ পাস হয়, তবে এর বাস্তব প্রয়োগ ছিল অত্যন্ত সীমিত। খুব কম সংখ্যক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ছাত্র আন্দোলন, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও দমন-পীড়ন চালিয়েছে পুলিশ। বিশেষত ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ চলাকালে পুলিশের ভূমিকা দেশব্যাপী সমালোচিত হয়।

এছাড়া ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ এবং ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ ব্যবহার করে ভিন্নমত দমন করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের অভিযোগ এনে বহু নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কমিশনের ভাষ্যমতে, বহু রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও সরকারের সমালোচকদের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এসব ঘটনা পুলিশের অভ্যন্তরে জবাবদিহির অভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে, যা সংবিধান অনুযায়ী নাগরিক অধিকার এবং আইনের শাসনের পরিপন্থী।

র‌্যাব: আইন রক্ষা বাহিনী থেকে দমনযন্ত্রে রূপান্তর২০০৪ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি আধাসামরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে গঠিত হয় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সন্ত্রাসবাদ, মাদক চোরাচালান ও সংঘবদ্ধ অপরাধ দমনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় এ বাহিনী ।

বর্তমানে দেশব্যাপী মোট ১৫টি ব্যাটালিয়ন রয়েছে র‌্যাবের অধীনে। প্রতিটি ব্যাটালিয়নের অধীনে তিন থেকে চারটি ‘ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানি’ (সিপিসি) কাজ করে। বাহিনীটি মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ১০টি কার্যকর শাখার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে অপারেশন, গোয়েন্দা, আইন ও গণমাধ্যম এবং বিমান শাখা অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (অপারেশন) অধীন এবং প্রশাসন ও অর্থ, যোগাযোগ ও এমআইএস, তদন্ত ও ফরেনসিক, প্রশিক্ষণ ও অভিযোজন, এবং গবেষণা ও উন্নয়ন শাখাগুলো অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (প্রশাসন) অধীন কাজ করে।

ঢাকার কুর্মিটোলায় র‌্যাবের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে র‌্যাব অপরাধ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, অল্প সময়ের মধ্যেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হতে থাকে।

তদন্ত কমিশন শত শত অভিযোগ পেয়েছে, যেখানে র‌্যাবের বিরুদ্ধে গুম, হেফাজতে নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছে, র‌্যাবের হাতে আটক হওয়া বহু ব্যক্তি পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছেন কিংবা আজও নিখোঁজ রয়েছেন। এতে বাহিনীটির মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

প্রথমদিকে সন্ত্রাসবাদ দমন বাহিনী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সমর্থন নিয়ে গঠিত হলেও, সময়ের সঙ্গে র‌্যাব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনকারী ‘ডেথ স্কোয়াডে’ পরিণত হয়। বাহিনীটি শুরু থেকেই ব্যাপক স্বাধীনতা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও, পর্যাপ্ত তদারকির অভাব তাদের নির্যাতন চালানোর সুযোগ তৈরি করে দেয়।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে যুক্তরাজ্য প্রায় এক দশক আগে র‌্যাবের সঙ্গে সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দেয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অভিযোগে র‌্যাব এবং এর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের সঙ্গে সমন্বয় করে গোপন অভিযান পরিচালনা করত। এসব অভিযানে সন্ত্রাস, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান দমনের নামে বহু অপহরণ ও গোপন স্থানে দীর্ঘদিন আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে।

সবচেয়ে সমালোচিত ছিল ঢাকার কুর্মিটোলায় র‌্যাব-১ সদর দপ্তরের ভেতরে অবস্থিত ‘টাস্ক ফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল’। প্রকাশ্যে এটিকে একাধিক সংস্থার যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র হিসেবে দেখানো হলেও, আসলে এটি র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ছিল।

এ কেন্দ্রে বন্দিদের দিনের পর দিন, এমনকি মাসের পর মাস অন্ধকার কক্ষে হাত-পা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় আটকে রাখা হতো। ৩৮টি সাক্ষ্যে উঠে আসে, এখানে বন্দিদের পিটিয়ে, বৈদ্যুতিক শক দিয়ে, উল্টো ঝুলিয়ে কিংবা শরীরের অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হতো। এমনকি শিশু ও মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরাও এই নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাননি। যদিও এই সেল পরিচালনায় সেনা সদস্যরাই মূলত দায়িত্বে থাকতেন, তবে পুলিশের সদস্যরাও অভিযানে অংশ নিতেন।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে র‌্যাব গোয়েন্দা কিংবা স্থানীয় ব্যাটালিয়নের মাধ্যমে অপহরণ করা কিংবা ডিজিএফআই হেফাজত থেকে আনা ব্যক্তিদের এই সেলে নিয়ে আসা হতো। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো, যাতে শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, নির্যাতন কেন্দ্রটি সম্পর্কে এখনও প্রতিদিন নতুন নতুন অভিযোগ আসছে, যা নির্যাতনের ব্যাপকতা ও ধারাবাহিকতা বোঝায়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর র‌্যাব সেলের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করতে সচেষ্ট হয়। নির্যাতনের প্রমাণ মুছে ফেলতে সেলগুলোর কাঠামো বদলানো, নির্যাতন কক্ষ ভেঙে ফেলা, নজরদারি ক্যামেরা সরিয়ে নেওয়া এবং ফরেনসিক প্রমাণ নষ্ট করতে মেঝের টাইলস পর্যন্ত তুলে ফেলা হয়। এটি ছিল প্রমাণ মুছে ফেলার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার অংশ।

র‌্যাবের বিরুদ্ধে শুধু অপরাধ দমনের নামে বাড়াবাড়ির অভিযোগ নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী দল, মানবাধিকারকর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন-পীড়নে র‌্যাবকে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, র‌্যাব সদস্যরা জানতেন যে তাদের বিচার হবে না। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি বাহিনীটিকে বেপরোয়া করে তুলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এর ফলে জনমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ভয় এবং বিচার পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। গোটা ব্যবস্থায় জবাবদিহিহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

সরকার পরিবর্তনের পরও র‌্যাব বাহিনীটি এখনও সক্রিয়। তবে অতীতের কার্যক্রম এবং জনমনে গড়ে ওঠা ভয় ও অনাস্থা আজও গণতান্ত্রিক সংস্কার পথে বড় বাধা হয়ে রয়েছে।

কমিশনের মতে, সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে হলে র‌্যাব বাহিনীটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা দরকার। তা না হলে দায়মুক্তির এই চক্র ভাঙবে না, জনআস্থা ফিরবে না এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।

এনএসআই’র আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি: গুম কমিশনজাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) যেন একটি আধুনিক, জবাবদিহিমূলক ও সংবিধানসম্মত গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে, সে লক্ষ্যে এর আইনি কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।

গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত এনএসআই বাংলাদেশের প্রধান বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ধরনের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ এর দায়িত্বের আওতায় পড়ে।

জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা, সন্ত্রাসবাদ দমন এবং রাজনৈতিক ও নাশকতামূলক তৎপরতার উপর নজরদারির পাশাপাশি সীমান্ত গোয়েন্দা কার্যক্রমেও এনএসআই সক্রিয়। তবে ডিজিএফআই ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) মতো অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কার্যক্রমের ক্ষেত্রে অধিকার ও দায়িত্বের ক্ষেত্র আচ্ছাদনে ওভারল্যাপ, অতিরিক্ত ব্যবহার এবং আন্তঃসংস্থাগত দ্বন্দ্ব প্রায়শই তৈরি হয়।

প্রতিবেদনটি জানায়, ক্রমবর্ধমান রাজনীতিকরণের কারণে এনএসআইয়ের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রকৃত হুমকির পরিবর্তে বিরোধী রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিকদের নজরদারি এবং দমন করার উদ্দেশ্যে সংস্থাটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

এনএসআই এখনও পর্যন্ত এমন কোনো বিস্তৃত, সংবিধানসম্মত আইনের আওতায় পরিচালিত হয় না, যা এর ক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা ও তদারকির কাঠামো স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করবে। ফলে স্বাধীন সংসদীয় বা বিচার বিভাগীয় তদারকির অভাব রয়েছে, যা কর্তৃত্বের অপব্যবহার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি বাড়ায়।

কমিশনের কাছে অভিযোগ এসেছে যে, এনএসআই জোরপূর্বক গুমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনে নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের সঙ্গেও এই সংস্থার সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর কার্যক্রমের গোপনীয়তা ও অস্বচ্ছতার কারণে ভুক্তভোগীরা আইনি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ থেকে প্রায়শই বঞ্চিত হন।

যদিও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা ও সন্ত্রাসবাদ দমনে এনএসআই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে, তবুও সংস্থাটি রাজনীতিকরণ, স্বচ্ছতার অভাব, পর্যাপ্ত তদারকির ঘাটতি এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।

কমিশন মনে করে, একটি কার্যকর ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এনএসআইয়ের আইনি কাঠামো ঢেলে সাজানো এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য।

সন্ত্রাসবাদ ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমন (সিটিটিসি)

২০১৬ সালে বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে প্রতিষ্ঠিত কাউন্টার টেরোরিজম ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ (সিটিটিসি) ইউনিটকে সন্ত্রাসবাদ, সংগঠিত অপরাধ ও আন্তঃদেশীয় অপরাধমূলক তৎপরতা মোকাবিলার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এই ইউনিটের অধীনে রয়েছে সাতটি বিশেষায়িত বিভাগ, যার মধ্যে স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ (সোয়াত), বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট, অবৈধ অস্ত্রবিরোধী ইউনিট, ক্যানাইন ইউনিট এবং সাইবার ক্রাইম ইউনিট উল্লেখযোগ্য।

সিটিটিসি নিজেদের উদীয়মান নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার দাবি করলেও, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর মতো অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে অপব্যবহার এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে।

এমনকি, অন্যান্য বাহিনীর তুলনায় কম সময়ের জন্য বেআইনিভাবে আটক রাখলেও, সিটিটিসি সদস্যরা আইনি প্রক্রিয়ার কৌশলগত অপব্যবহারের মাধ্যমে গুরুতর ক্ষতির কারণ হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই ইউনিট মিথ্যা মামলার মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্যও পরিচিত। এতে বিচার বিভাগ কার্যত দমন-পীড়নের অংশ হয়ে ওঠে।

সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডের নামে বিদেশি সরকারের সহায়তায় গঠিত র‌্যাবের মতোই সিটিটিসিও আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছে। তবে, এই বিদেশি সহায়তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতা ঠেকাতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।

সিটিটিসি জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন ও নির্বিচারে আটকের মতো গুরুতর অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে।

বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে মানবাধিকার কর্মীরা তথাকথিত সন্ত্রাসী বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ব্যক্তিদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এগুলো আইনের শাসনকে ক্ষুণ্ন করেছে এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের অবিশ্বাসকে আরও সুদৃঢ় করেছে।

কমিশন এমন অসংখ্য ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, যেখানে ব্যক্তিদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে ও জিজ্ঞাসাবাদের আড়ালে তাদের নির্যাতন করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে, পরে ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়েছিল।

আটক ব্যক্তিরা তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বা জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের উদ্দেশ্যে নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। চাপের মুখে দেওয়া এই ধরনের স্বীকারোক্তি তদন্ত ও বিচারিক কার্যক্রমকে প্রভাবিত করেছে।

কমিশনের সাক্ষাৎকার নেওয়া ভুক্তভোগীরা সিটিটিসি হেফাজতে থাকাকালীন মানসিক যন্ত্রণা ও শারীরিক নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেছেন।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও সুষ্ঠু প্রাতিষ্ঠানিক তদারকির অভাবে যার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নির্যাতন চলতে থাকে।

সিটিটিসি যথাযথ প্রমাণ বা আইনি ভিত্তি ছাড়াই নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে। বিশেষ করে যারা সরকারের বিরোধী বলে বিবেচিত রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ ছিল, তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হয়।

এই পদক্ষেপগুলো প্রকৃত নিরাপত্তা হুমকির প্রতিক্রিয়া নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়। ভুক্তভোগীদের অনেকে জানিয়েছেন, বিনা অপরাধে তাদের আটক করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বিচারহীনতার চিত্রকেই তুলে ধরে।

সিটিটিসি দীর্ঘদিন ধরে কার্যত অস্বচ্ছতার আবরণে কাজ করেছে। তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জনসাধারণকে কিছুই জানানো হয়নি। সংস্থাটির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠলেও অর্থবহ কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

অবৈধ আটক, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের খুব কম ক্ষেত্রেই বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। ফলে সিটিটিসির ভেতরে দায়মুক্তির একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে — যা একসময় র‌্যাবের গ্রহণযোগ্যতাও ক্ষুণ্ন করেছিল।

কমিশনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিটিটিসি একটি নিরপেক্ষ সন্ত্রাসবিরোধী সংস্থার ভূমিকায় না থেকে সেই পুরনো অনুশীলন ও দায়মুক্তির ধারাই অব্যাহত রেখেছে, যেটির জন্য আন্তর্জাতিক মহল একসময় অন্যান্য বাহিনীর সমালোচনা করেছিল।

র‌্যাবের অভিজ্ঞতা এক সতর্ক সংকেত হয়ে থাকা সত্ত্বেও, সিটিটিসি এখন একই ধরনের একটি সন্ধিক্ষণে রয়েছে। যেখানে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা, বিদেশি সহায়তা এবং রাজনৈতিক অপব্যবহার পদ্ধতিগত মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং জনআস্থার মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করছে।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত