ঢাকা, শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

ভূমিকম্প: কুরআন, হাদিস ও বিজ্ঞানের আলোকে বিপর্যয়ের কারণ-প্রতিকার

২০২৫ নভেম্বর ২৮ ১৫:৩৬:৩৪

ভূমিকম্প: কুরআন, হাদিস ও বিজ্ঞানের আলোকে বিপর্যয়ের কারণ-প্রতিকার

সরকার ফারাবী: সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো মানুষের মনে যেন অচেনা আতঙ্ক ফিরিয়ে এনেছে প্রলয়ের স্মৃতি এবং সর্বশক্তিমান স্রষ্টার অশেষ ক্ষমতার প্রতি গভীর উপলব্ধি। ভূ-তত্ত্ববিদরা এগুলোকে টেকটোনিক প্লেটের স্বাভাবিক সংঘর্ষ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও একজন ঈমানদার মানুষের কাছে এই ঘটনা শুধুই ভূগর্ভের আলোড়ন নয় বরং আত্মসমালোচনা, ঈমানের পরীক্ষা এবং মানবজাতির জন্য নিত্য নতুন সতর্কবার্তা।

এই বিশেষ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো আসমানী দৃষ্টিতে ভূমিকম্পের কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনা এবং আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে ভূমিকম্প মোকাবিলার উপায়।

আসমানী দৃষ্টিকোণ: কেন ঘটে ভূমিকম্প

ইসলামিক দর্শনে প্রতিটি প্রাকৃতিক ঘটনা আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। মানুষের কর্ম, নৈতিক স্খলন এবং মানবজাতির আচরণ আল্লাহর সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে এ মতের ভিত্তিতেই ধর্মগ্রন্থে ভূমিকম্পের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

১. কুরআনের আলোকে ভূকম্পনের বার্তা

কিয়ামতের পূর্বাভাস:

কিয়ামতের দিনের বিভীষিকার প্রথম দৃশ্যই হলো প্রচণ্ড ভূকম্পন। আল্লাহ বলেন- “হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো। নিশ্চয়ই কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়াবহ ঘটনা।” (সূরা আল হাজ্জ ২২:১)

পৃথিবীর ভাষ্য:পৃথিবী আল্লাহর আদেশেই আন্দোলিত হয় এবং কিয়ামতের দিন নিজের ইতিহাস প্রকাশ করবে “যখন পৃথিবী ভয়ানক কম্পনে কেঁপে উঠবে… আর সে নিজের সব খবর বর্ণনা করবে।” (সূরা আঝ যিলযাল ৯৯:১–৫)

মানুষের কৃতকর্মের প্রতিফলন:আল্লাহ ঘোষণা করেন “তোমাদের ওপর যে বিপদ আসে, তা তোমাদের হাতের উপার্জনের ফল।” (সূরা আশ শুরা ৪২:৩০)

২. রাসূল (সা.)-এর সতর্কবাণী

হাদিসে উল্লেখ আছে পাপের আধিক্য, অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, জ্ঞানের ক্ষয় এবং রক্তপাত এগুলো কিয়ামতের নিকটবর্তী লক্ষণ, এবং ভূমিকম্প এর একটি অংশ।

রাসূল (সা.) বলেছেন- “ভূমিকম্প বৃদ্ধি পাবে না পর্যন্ত কিয়ামত আসবে না।” (বুখারি: ১০৩৬)

আধ্যাত্মিক সুরক্ষা: বিশ্বাসীর দায়িত্ব কী?

যেহেতু বিপদ মানুষের কর্মফলেরই প্রতিফলন, তাই একজন মুসলিমের জন্য আল্লাহর শরণ নেওয়াই সর্বোত্তম প্রতিকার।

ইস্তিগফার- পাপমোচন ও নিরাপত্তা

রাসূল (সা.) বলেছেন যে বান্দা নিয়মিত ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাকে দুঃখ–কষ্ট থেকে রক্ষা করেন।(আবু দাউদ: ১৫১৮)

তাওয়াক্কুল- আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা

আল্লাহ ঘোষণা করেছেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” (সূরা বাকারাহ ২:১৫৩)

দরুদ শরিফ বৃদ্ধি

রাসূল (সা.) বলেছেন- “যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার ওপর দশবার রহমত নাজিল করেন।” (নাসাঈ: ১২৯৮)

সালাত- দুর্যোগে আল্লাহর সাহায্যের শ্রেষ্ঠ উপায়

বিপদের সময়ে বেশি বেশি সালাত আদায় করতে কুরআন নির্দেশ দিয়েছে।

দোয়া

দোয়ায়ে ইউনুস: “লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জালিমিন।” (সূরা আল আম্বিয়া: ৮৭)

রাসূল (সা.)–এর দোয়া: “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল আজিমুল হালিম…” (মুসলিম: ২৭৩০)

সাদাকাহ- বিপদ দূর হওয়ার বড় মাধ্যম

রাসূল (সা.) বলেছেন- “সাদাকাহ আল্লাহর গজব প্রশমিত করে এবং অপমৃত্যুকে দূর করে।” (তিরমিযি: ৬৬১)

আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সুরক্ষা

ধর্মীয় রক্ষার পাশাপাশি জীবন বাঁচানোর জন্য বৈজ্ঞানিক প্রস্তুতি অপরিহার্য।

১. প্রকৌশল নির্দেশনা

ভূমিকম্প সহনশীল নকশা অনুসারে ভবন নির্মাণ

পুরনো ও দুর্বল ভবনের রেট্রোফিটিং

বড় শহরে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন

২. ৭২ ঘন্টার জরুরি কিট

পানি

শুকনা খাবার

ফার্স্ট এইড

টর্চ, বাঁশি

প্রয়োজনীয় নথি

ব্যাটারি চালিত রেডিও

৩. ভূমিকম্পের সময় করণীয় (FEMA নির্দেশিত)

ঘরের ভিতরে:

টেবিল–ডেস্কের নিচে আশ্রয়

কাচ, জানালা, বড় আসবাব দূরে থাকা

লিফট–সিঁড়ি ব্যবহার না করা

বাইরে:

খোলা স্থানে থাকা

বিল্ডিং, গাছ, তার থেকে দূরে থাকা

গাড়িতে:

খোলা জায়গায় থামা

সেতু বা ওভারপাস এড়িয়ে চলা

ধ্বংসাবশেষে চাপা পড়লে:

আগুন না জ্বালানো

কম নড়া–চড়া করা

হাত দিয়ে নয়, হুইসেল/দেওয়াল চাপ দিয়ে সংকেত দেওয়া

সম্মিলিত দায়িত্ব

ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিক পরিবর্তন, ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রস্তুতি গ্রহণ এই দুই পথেই নিরাপদ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। বিপদাপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং সতর্ক থাকা আমাদের যৌথ কর্তব্য।

আল্লাহ যেন মানবজাতিকে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিরাপদ রাখেন।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত