ঢাকা, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০ কার্তিক ১৪৩২

ডাকসুর সহযোগিতায় প্রকাশনা উৎসবে এক মঞ্চে গুমের ভুক্তভোগী ও স্বজনেরা

২০২৫ অক্টোবর ২৫ ১৮:৫০:২৯

ডাকসুর সহযোগিতায় প্রকাশনা উৎসবে এক মঞ্চে গুমের ভুক্তভোগী ও স্বজনেরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও প্রচ্ছদ প্রকাশনের উদ্যোগে আয়োজিত প্রকাশনা উৎসবে এক মঞ্চে মিলিত হলেন গুমের শিকার ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনরা।

শনিবার (২৫ অক্টোবর) সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ মুজিবুর রহমান হল অডিটোরিয়ামে ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম (আরমান) রচিত ‘আয়নাঘরের সাক্ষী: গুম জীবনের আট বছর’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান এবং “গুম ফ্যাসিবাদী শাসনের নিকৃষ্ট হাতিয়ার” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসন পুরো বাংলাদেশকেই বন্দি করে রেখেছিলো। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দিন শেষ হয়েছে, এখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে এগোচ্ছে। অপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। অন্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং বাংলাদেশের জনগণ এবং নিপীড়িত মানুষেরা ন্যায় বিচার পাবে। জুলাই ঘোষণা এবং জুলাই সনদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ নতুন বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে। এই সংগ্রাম চলমান এবং এই লড়াই আগামী দিনের ভবিষ্যতের জন্য। ফ্যাসিবাদ পরাজিত হলেও বারবার ফিরে আসার চেষ্টা করে, তাই আমাদের মতভেদ থাকা সত্ত্বেও সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

অনুষ্ঠানে ডাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) সাদিক কায়েম বলেন, খুনী হাসিনা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ইনস্টিটিউশনগুলোকে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদ বিরোধীদেরকে গুম করেছে, খুন করেছে। জুলাই বিপ্লবের ফলে গুমের শিকার ব্যারিস্টার আরমান ভাই, হুম্মাম কাদের চৌধুরী ভাইসহ কয়েকজনকে ফিরে পেয়েছি। কিন্তু আমরা এখনো জানিনা ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা ওলিউল্লাহ, বিএনপির ইলিয়াস আলী, সুমন ভাই কোথায় আছে। জার্মানিতে যেভাবে নাৎসি বাহিনীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ইতালিতে যেভাবে মুসোলিনিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে একইভাবে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, খুনি হাসিনার দোসরদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নাই। তাদেরকে যেখানে পাওয়া যাবে থানায় দিতে হবে, দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, ‘আয়নাঘরের সাক্ষী’ বইটি গুম ও নির্যাতনের ভয়াবহ বাস্তবতা সামনে এনেছে। ছোট ডিটেনশন সেলে ইলেকট্রিক শক, ঝুলিয়ে নির্যাতন, লেথাল ইনজেকশন, রেললাইনে ফেলে দেওয়া, বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষা নদী বা অন্যান্য জায়গায় নিয়ে তাদের পেট ছিঁড়ে সিমেন্টের বস্তা দিয়ে ভারী করে তাদেরকে ফেলে দেওয়া এসব ছিল ফ্যাসিবাদী শাসনের নৃশংস হাতিয়ার। এরকম কত হাজারো ভাইয়ের সাথে এমন হয়েছে আমরা জানতে চাই। আমাদের ভাই, স্বামী, সন্তানের সঙ্গে আসলে কী ঘটেছিল, তারা জীবিত না মৃত এই সত্য জানার অধিকার আমাদের আছে। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিবাদী শাসনের সময় যারা গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের প্রতিটি ঘটনার স্বচ্ছ তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আজ আমরা কথা বলতে পারছি, বিচার চাইতে পারছি এটাই নতুন বাংলাদেশের পরিবর্তনের প্রতীক। এই পথচলায় সকল নিপীড়িত পরিবার ঐক্যবদ্ধ থেকে ন্যায়বিচারের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।

গুম ফেরত সাবেক বিগ্রেডিয়ার আব্দুল্লাহিল আমান আযমি বলেন, পৃথিবীতে এমন কোনো বিপ্লব নেই যেখানে শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ অংশগ্রহণ করেছে এবং সফল হয়েছে। জুলাই বিপ্লব হয়েছে দুর্নীতি, জুলুম বন্ধ করে মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের জন্য। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাসূল সাঃ বৈষম্য করেনি। রাসূল সাঃ বলেছিলেন নিজের মেয়ের বিরুদ্ধেও আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করবেন। আমাকে অনেকে জেনারেলদের বিরুদ্ধে মামলা না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। কিন্তু আমি যদি কোনো গুম খুনের বিরুদ্ধে কথা না বলে বৈষম্য করি তাহলে আল্লাহর কাছে জবাব দেওয়া লাগবে। এই মামলা করেছি প্রতিহিংসার জন্য নয়। ভবিষ্যতের অন্ধ আনুগত্যকারী জেনারেল তৈরির পথ এবং ফ্যাসিবাদের পথ বন্ধ করার জন্য।

বইয়ের লেখক ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম (আরমান) আট বছর গুম জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গুম থেকে ফেরত আসার পরও আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে, আমি থাকব না দেশে, চলে যাব। দরকার নাই ,যেখানে অধিকার নাই, যেখানে আইন নাই, যেখানে আদালত নাই, সেখানে সংবিধান নাই, থাকবো না সেই দেশে। কিন্তু যখন সুমনের মায়ের দিকে তাকাই, সুমনের মা যখন প্রশ্ন করে, 'আমার বাবা কোথায়?' তখন মনে করি, সৃষ্টিকর্তা আমাকে নিজ হাতে জীবিত রেখেছেন। আমার দায়িত্ব তাদের জন্য কথা বলা যারা জীবিত বের হতে পারেননি৷ আসুক যত বিপদ, আসুক যত হুমকি, যাব না এই দেশ থেকে। এই দেশের মানুষের অধিকার আদায় করে থাকব এই দেশে ইনশাল্লাহ। যতদিন জীবিত আছি এই মানুষের অধিকার আদায়ে নিয়োজিত থাকব ইনশাল্লাহ।'

তিনি আরও বলেন, আমাদের হতাশ চললে হবে না। আমাদের আস্থা রাখতে হবে জুলাই যোদ্ধাদের ওপর। যখন পুলিশ বাহিনী উধাও হয়ে গিয়েছিল বাচ্চা ছেলে মেয়েরা তারা রাস্তায় বেরিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই বাচ্চা ছেলেমেয়েরা আমাকে আবার স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছে। আমি আবার স্বপ্ন দেখি এমন বাংলাদেশের, যেখানে থাকবে না আঞ্চলিকতার বৈষম্য, যেখানে থাকবে না মতাদর্শ, ধর্ম নিয়ে বৈষম্য। আমরা শুধু চিনব মানুষ, আমরা নাগরিক। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে ভাই বোনের মতো সবাই একসাথে বসবাস করবো। পরবর্তী বংশধরদের জন্য একটি সুখী সমৃদ্ধশালী ঐক্যের বাংলাদেশ রেখে যাব ইনশাআল্লাহ।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের হেড অব মিশন হুমা খান, বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকী, আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেমের (আরমান) মা খন্দকার আয়েশা খাতুন ও তার স্ত্রী ফারহানা ফাখরুবা তাহমিনা, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তাজরিয়ান আকরাম খান ও প্রচ্ছদ প্রকাশনের চেয়ারম্যান রাজিফুল হাসান বাপ্পী, ডাকসুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক মুসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ, শেখ মুজিবুর রহমান হল সংসদের ভিপি মুসলিমুর রহমান প্রমুখ।

এসপি

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত