ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০ আশ্বিন ১৪৩২

জেন জি বিক্ষোভে সোশ্যাল মিডিয়া: সুযোগ না বিপদ?

২০২৫ সেপ্টেম্বর ২৪ ১৪:৪৮:৩৩

জেন জি বিক্ষোভে সোশ্যাল মিডিয়া: সুযোগ না বিপদ?

বিশেষ প্রতিবেদন: ২৩ বছর বয়সী তরুণ সমাজকর্মী আদিত্যর রাগের সূত্রপাত হয়েছিল একটি নেপালি রাজনীতিবিদের কন্যার বিয়ের খবর দিয়ে। মে মাসে সামাজিক মাধ্যমে সেই বিয়ের খবর পড়ার সময় তিনি লক্ষ্য করেন, ভক্তপুর শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো VIP অতিথিদের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ ছিল। খবর অনুযায়ী উপস্থিত ছিলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রীও।

যদিও পরে এই দাবি সত্যতা পায়নি এবং রাজনীতিবিদ নিজে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেন, আদিত্যর মনোভাব তখনই স্থির হয়ে যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, "এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।"

এরপর কয়েক মাস ধরে তিনি লক্ষ্য করেন রাজনীতিবিদ ও তাদের সন্তানদের সামাজিক মাধ্যমে নানা বিলাসবহুল জীবনধারার ছবি—প্রাচুর্যপূর্ণ ছুটি, বিশাল প্রাসাদ, সুপারকার এবং ব্র্যান্ডেড হ্যান্ডব্যাগ। এক ভাইরাল ছবি ছিল প্রদেশের একজন মন্ত্রীর পুত্র সৌগাত থাপার, যেখানে লুই ভিটন, গুচি, কার্টিয়ের এবং ক্রিশ্চিয়ান লুবুটিনের উপহারবস্তুর একটি বিশাল স্তূপ, সাজানো হয়েছে ক্রিসমাস লাইট এবং সান্তা হ্যাট দিয়ে।

এ ধরনের সামাজিক বৈষম্য তরুণদের মধ্যে ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নেপালের তরুণরা এই ধরনের রাজনীতিবিদ সন্তানদের ‘নেপো কিডস’ বলে অভিহিত করছে।

বিক্ষোভে উত্তেজনা: প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ

৮ সেপ্টেম্বর আদিত্য ও তার বন্ধুরা কাঠমান্ডুর সড়কে হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর সঙ্গে যোগ দেন। এই ‘দূর্নীতি বিরোধী’ বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়, যার ফলে কিছু বিক্ষোভকারী মারা যান। পরের দিন, মানুষ সংসদ ভবন ভেঙে ফেলে এবং সরকারি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর প্রভাবে প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলি পদত্যাগ করেন। মোট প্রায় ৭০ জন নিহত হন।

এশিয়াজুড়ে তরুণদের ক্রোধ

এই আন্দোলন নেপালের বাইরে অন্য এশীয় দেশেও দেখা গেছে। ইন্দোনেশিয়ায় ও ফিলিপিনসে হাজার হাজার তরুণ প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন। মূল কারণ, এই প্রজন্মের তরুণরা দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দূর্নীতি এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ।

তাদের মতে, ‘নেপো কিডস’ শুধু এক ধরনের প্রতীক—যারা ক্ষমতাসীন পরিবার থেকে সুবিধা পায়—এবং তারা দেখায় দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার গভীর দূর্নীতি।

ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিনসে প্রতিবাদ

ইন্দোনেশিয়ার উত্তর সুমাত্রার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ২২ বছর বয়সী জিক্রি আফদিনেল সিরেগার বলেন, স্থানীয় আইনপ্রণেতারা মাসে ৬০ মিলিয়ন রুপি (প্রায় ২,৬৭০ পাউন্ড) হাউজিং ভাতা নিচ্ছেন, যা গড়ে সাধারণ মানুষের আয়ের ২০ গুণ। তার পরিবার সাধারণ কৃষক, মাসে মাত্র ৪ মিলিয়ন রুপি আয় করে।

ফিলিপিনসে ৩০,০০০ জন মানুষ একটি Reddit থ্রেডে 'লাইফস্টাইল চেক' ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়েছেন, যেখানে দেশটির ধনীরা কীভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে তার তথ্য শেয়ার করা হচ্ছে।

সামাজিক মাধ্যম ও AI-র ব্যবহার

নেপালে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অধিকাংশ সাইটে বাধা দেয়। কিন্তু তরুণরা এটিকে নিজেদের স্বর দমন করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছিল।

আদিত্য ও তার চার বন্ধু লাইব্রেরিতে বসে চ্যাটজিপিটি, গ্রক, ডিপসীক এবং ভিড-এর মতো AI প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ৫০টি সামাজিক মিডিয়া ভিডিও তৈরি করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল নেপো কিডস এবং দূর্নীতি নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। তারা ভিডিওগুলো TikTok-এ পোস্ট করে, যেখানে প্রথম ভিডিওটি ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পর্কিত, এবং শেষাংশে ছিল একটি আহ্বান: "আমি অংশ নেব। আমি দূর্নীতি এবং রাজনৈতিক শ্রেণিবিভাজনের বিরুদ্ধে লড়ব। আপনি কি করবেন?"

ভিডিওটি ১ দিনের মধ্যে ১,৩৫,০০০ বার দেখা হয় এবং অন্যান্য অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে তা আরও ছড়িয়ে পড়ে।

প্রযুক্তি, সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক সংহতি

তরুণরা Discord ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আন্দোলন পরিকল্পনা করেছে। ইন্দোনেশিয়ার কার্টুন স্কাল লোগো এবং #SEAblings হ্যাশট্যাগ ফিলিপিনস ও নেপালের প্রতিবাদকারীরা গ্রহণ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি শুধু সংগঠনের কাজ সহজ করছে না, একই সঙ্গে এই আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক সংহতির আকার দিচ্ছে।

দুর্গত প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

বিক্ষোভের ফলে বিভিন্ন সরকারি ভবন পুড়ে গেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নেপালে ৭০ জন নিহত, ইন্দোনেশিয়ায় ১০ জন।

সরকার এই সহিংসতাকে নিন্দা জানিয়েছে, তবে কিছু দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ায় কিছু আর্থিক প্রণোদনা বাতিল হয়েছে, এবং ফিলিপিনসে দুর্যোগ প্রতিরোধ তহবিলের সম্ভাব্য অনিয়ম তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, ডিজিটাল আন্দোলনগুলো দীর্ঘমেয়াদে মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন আনতে চ্যালেঞ্জের মুখে। লিডারহীন আন্দোলন প্রাথমিকভাবে আন্দোলনকে দ্রুত সম্প্রচার করতে সহায়ক হলেও দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করে।

নেপালের এই প্রজন্মের তরুণরা আশাবাদী। আদিত্য বলেন, "আমরা আমাদের পূর্ব প্রজন্মের ভুল থেকে শিখছি। আমরা কোনো নেতাকে দেবতার মতো পূজ করি না। আমরা সবাই সমানভাবে সক্রিয় অংশীদার।"

এমজে

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

সর্বোচ্চ পঠিত