ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২ আশ্বিন ১৪৩২

সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বাজারে স্বস্তি কেন নেই?

২০২৫ সেপ্টেম্বর ১৮ ০১:০৫:১০

সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বাজারে স্বস্তি কেন নেই?

নিজস্ব প্রতিবেদক: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফিরছে না। চাল, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ও ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা কার্যকর হয়নি, যার ফলে গত এক বছরে ওষুধসহ প্রায় সকল প্রকার ব্যবহার্য ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস উঠেছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজার অস্থিরতার পেছনে রয়েছে চাঁদাবাজি, অধিক মুনাফার লোভ, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং সরকারের সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনাও এক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চ্যালেঞ্জিং হলেও সরকারকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাংলাদেশ ভোক্তা সমিতি (ক্যাব) মনে করে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার কথা জানিয়েছেন। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন জরুরি সভা করেছেন, খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন, এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন সিন্ডিকেট ভাঙতে অর্থ, খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সিন্ডিকেট ভাঙার কথা বলেছেন এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে এতকিছুর পরেও সাধারণ মানুষের বাজারে স্বস্তি মিলছে না।

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, সিন্ডিকেট ব্যবসা, লোকবল সংকটের কারণে বাজার মনিটরিংয়ের অভাব এবং সরকারি উদ্যোগের অকার্যকারিতা নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসার প্রধান কারণ। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মুনাফা বাড়াচ্ছে, এবং পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না।

বাজার সংশ্লিষ্টরা কার্যকর বাজার মনিটরিং, সিন্ডিকেট ভাঙতে কঠোর আইন প্রয়োগ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি রোধ এবং সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুল্ক ও কর কমানো, খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়ানো, বাজার তদারকি জোরদার করা এবং ডলারের মজুদ বাড়ানো সরকারের প্রধান হাতিয়ার হতে পারে।

টিসিবি’র তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার (২০২৪ সালের ৮ আগস্ট) পর থেকে ২০২৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোটা চাল, আটা, সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, চিনি, ব্রয়লার মুরগি এবং ডিমের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যদিও আলুর দাম কিছুটা কমেছে। এই সময়ের মধ্যে প্রতি ডলারের মূল্য ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১১৮-১২০ টাকায় পৌঁছেছে। খাদ্যপণ্য ছাড়াও সাবান, শ্যাম্পু, লোশনসহ সকল প্রকার ওষুধের দামও বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আলু, ডাল, সবজি, ধান এবং ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চাল উৎপাদন ৪ কোটি ৬৬ লাখ টন ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস থাকলেও, এই বর্ধিত উৎপাদন সত্ত্বেও পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ, মজুদ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ, ট্যারিফ কমিশন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম জোরদার, কিছু আমদানি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক ডিউটি প্রত্যাহার, শুল্ক ছাড় দিয়ে চাল আমদানির পথ খুলে দেওয়া এবং জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো। টিসিবির মাধ্যমে ৭০ লাখ ফ্যামিলি কার্ডে ৩০ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি চাল বিক্রি করা হচ্ছে এবং ২ হাজার ৩৬৩টির বেশি ওএমএস ডিলারদের মাধ্যমেও চাল সরবরাহ করা হচ্ছে।

সিপিডি’র ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান পণ্যের সংকট রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, ব্যবসায়ীদের রেজিস্টারভুক্ত রাখা, ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন এবং সরকারের মনিটরিং বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। ক্যাবের প্রেসিডেন্ট এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি ব্যবস্থাপনায় খাদ্যপণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা, নিয়মিত মূল্যবৃদ্ধি না করা খুচরা ব্যবসায়ীদের কর সুবিধা ও স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। তিনি একটি অনলাইন পোর্টাল ব্যবহারের মাধ্যমে নগদবিহীন কেনাবেচা উৎসাহিত করার কথা বলেছেন। এছাড়াও, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ড এবং ব্যবসায়িক সংগঠন মিলে একটি সমন্বয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে বাজার তদারকি এবং উপজেলাভিত্তিক হিমাগার স্থাপন করে পচনশীল খাদ্যপণ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার ওপর ক্যাব গুরুত্বারোপ করেছে।

এসপি

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

সর্বোচ্চ পঠিত