ঢাকা, বুধবার, ২৭ আগস্ট ২০২৫, ১২ ভাদ্র ১৪৩২

ব্যাংকিং খাতে এমডিদের পদত্যাগের ঢেউ: সুশাসনের সংকট স্পষ্ট

ডুয়া নিউজ- অর্থনীতি
২০২৫ আগস্ট ২৬ ২১:২০:৫২
ব্যাংকিং খাতে এমডিদের পদত্যাগের ঢেউ: সুশাসনের সংকট স্পষ্ট

দেশের ব্যাংকিং খাতে এক সময় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদকে সর্বোচ্চ মর্যাদার প্রতীক এবং পেশাগত জীবনের শীর্ষ সাফল্য হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু এখন এ পদটি পরিণত হয়েছে ‘হট সিটে’। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক শীর্ষ নির্বাহীরা চাকরি হারাচ্ছেন বা পদত্যাগ করছেন, যা খাতটিতে গভীর সুশাসন সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে কঠোর নজরদারি শুরু করেছে। অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে এক ডজনেরও বেশি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে এমডিদের ওপর—পর্ষদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক চাপের কারণে তারা বিপাকে পড়ছেন।

শুধু গত তিন মাসেই পাঁচটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। তবে অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, এর পেছনে প্রধান কারণ পর্ষদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। গত বছরের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ৪৩টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ১৪টির শীর্ষ নির্বাহী পরিবর্তন হয়েছে। কেউ কেউ অনিয়মের তদন্তে অপসারিত হয়েছেন, কেউ আবার বিদেশে পালিয়েছেন বা কারাগারে গেছেন।

বর্তমানে অন্তত দশটি ব্যাংক অন্তর্বর্তীকালীন এমডির হাতে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে সম্প্রতি সাউথইস্ট ব্যাংকের নূরউদ্দিন মো. সাদেক হোসেন এবং মেঘনা ব্যাংকের কাজী আহসান খলিল পদত্যাগ করেছেন। তিন বছরের চুক্তির মাত্র ১৫ মাস পরই দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হন খলিল। তার অভিযোগ, কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই পর্ষদ তাকে জোরপূর্বক ছুটিতে পাঠায়। অন্যদিকে, সাউথইস্ট ব্যাংকের এমডি নূরউদ্দিন মো. সাদেক হোসেন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলেও, পর্ষদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বলি হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সমস্যার মূলে রয়েছে পরিচালনা পর্ষদের প্রভাব বিস্তার। অনেক পর্ষদ সদস্য রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এবং তারা নিয়ম বহির্ভূত ঋণ পুনঃতফসিল বা সুদ মওকুফে চাপ সৃষ্টি করেন। এই চাপ প্রতিরোধ করলেই এমডিদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়ে।

একজন ব্যাংকার জানান, একটি প্রভাবশালী কোম্পানি ১০টি ব্যাংকের ৩১ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের পাশাপাশি সুদ মওকুফ চেয়েছিল। ব্যাংকাররা আপত্তি জানালে পর্ষদের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয়। আরেকজন এমডি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “পর্ষদ এখনো ব্যাংকের মালিকের মতো আচরণ করে, অথচ ব্যাংকের ৯০ শতাংশ টাকা আমানতকারীদের।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের হুইসেলব্লোয়ার নীতি থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর নয়। অনেক এমডি অভিযোগ করেছেন, তারা গোপন তথ্য প্রকাশ করার পর তা ফাঁস হয়ে যায়, যার ফলে তাদের পদত্যাগে বাধ্য হতে হয় বা চুক্তি নবায়ন করা হয় না।

অধিকারকর্মীরা বলছেন, জনস্বার্থ তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা) আইন, ২০১১–তে বড় ধরনের ঘাটতি আছে। সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় হুইসেলব্লোয়াররা সুরক্ষা পান না। বিশেষজ্ঞরা তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে একটি স্বতন্ত্র হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা ইউনিট গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুহাম্মদ এ (রুমি) আলী এই ধারাবাহিক পদত্যাগকে ‘অস্বাস্থ্যকর প্রবণতা’ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, যারা সরে যাচ্ছেন তাদের অনেকেই যোগ্য ও পেশাদার ব্যাংকার এবং তাদের বিদায় ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট তৈরি করছে।

তিনি সতর্ক করে বলেন, “এতগুলো ব্যাংক যদি অন্তর্বর্তীকালীন এমডির হাতে পরিচালিত হতে থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে। ব্যাংকের মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বে বারবার অস্থিরতা তৈরি হলে আমানতকারীরা অনিশ্চয়তায় ভোগেন। এর ফলে ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।”

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত