ঢাকা, বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫, ৫ ভাদ্র ১৪৩২

ব্যাংক খাতে বড় ধস: মূলধন ঘাটতিতে ২৩ ব্যাংক

ডুয়া নিউজ- অর্থনীতি
২০২৫ আগস্ট ২০ ০৬:৫৩:০০
ব্যাংক খাতে বড় ধস: মূলধন ঘাটতিতে ২৩ ব্যাংক

দেশের ব্যাংক খাত এক ভয়াবহ সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মূলধন ঘাটতি দিন দিন এতটাই গভীর হচ্ছে যে, তা পুরো আর্থিক ব্যবস্থাকে অস্থির করে তুলছে। একের পর এক ব্যাংক এই ঘাটতির ফাঁদে পড়ছে এবং সেই অঙ্ক এখন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত ও বেসরকারি—মোট ২৩টি ব্যাংক বর্তমানে মূলধন ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ২৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও দুর্নীতিপূর্ণ ঋণ বিতরণই এই অবস্থার মূল কারণ। খেলাপি ঋণের পাহাড় তৈরি হয়ে যাওয়ায় তা আর ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। এর চাপ পুরো ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট কেবল সংখ্যার অঙ্ক নয়; এটি পুরো ব্যাংক খাতের দুর্বল কাঠামোগত সমস্যার প্রতিফলন। রাজনৈতিক প্রভাব, অদক্ষ পরিচালনা পর্ষদ এবং স্বচ্ছতা–জবাবদিহির ঘাটতি পরিস্থিতিকে দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নতুন করে বেশ কিছু ব্যাংকের ভেতরের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক এবং আইএফআইসি ব্যাংক মূলধন ঘাটতির নতুন তালিকায় যুক্ত হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অতীতে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণের যে প্রবণতা ছিল, সরকারের পরিবর্তনের পর সেটিই এখন নগ্নভাবে সামনে আসছে। ফলে দুর্বল আর্থিক অবস্থার বাস্তব চিত্র ঘাটতির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সবচেয়ে বড় ঘাটতিতে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক—১৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক (১৭ হাজার ৪৯২ কোটি), জনতা ব্যাংক (১২ হাজার ৭৬৮ কোটি), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (৭ হাজার ৭৯০ কোটি), ন্যাশনাল ব্যাংক (৬ হাজার ৯৩৮ কোটি ৭০ লাখ) এবং ইসলামী ব্যাংক (৬ হাজার ৪৫৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা)।

এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক (৫ হাজার ৮২২ কোটি), পদ্মা ব্যাংক (৫ হাজার ১৭০ কোটি ৭০ লাখ), রূপালী ব্যাংক (৪ হাজার ৪৭০ কোটি), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক (৩ হাজার ৯৮০ কোটি ৬১ লাখ), এবি ব্যাংক (৩ হাজার ৬৯৩ কোটি) এবং বেসিক ব্যাংক (৩ হাজার ৫০৬ কোটি) বড় অঙ্কের ঘাটতিতে রয়েছে।

আরও দেখা গেছে, আইএফআইসি ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ৬৯৮ কোটি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ২ হাজার ৫১০ কোটি ৬৯ লাখ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ৮১ লাখ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ১ হাজার ৭৮২ কোটি, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ৪৯৮ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক ১ হাজার ১৭১ কোটি, ইউসিবি ৯৫৪ কোটি, এক্সিম ব্যাংক ৫২১ কোটি, সিটিজেনস ব্যাংক ৮৬ কোটি, সীমান্ত ব্যাংক ২৬ কোটি এবং হাবিব ব্যাংক ৩৬ লাখ টাকার ঘাটতিতে রয়েছে।

এ বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি মূলধন ঘাটতির বড় কারণ। আগে যেসব ঋণ গোপন রাখা হয়েছিল, এখন সেগুলো প্রকাশ পাওয়ায় খেলাপির অঙ্ক দ্রুত বাড়ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে মূলধনের ওপর।

তিনি আরও বলেন, গত সরকারের সময়কার অনিয়ম আর লুটপাটের ফলেই আজ অনেক ব্যাংক গভীর সংকটে পড়েছে। দুর্বল ব্যবস্থাপনাই তাদের মূলধন ঘাটতির মূল কারণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকও পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নেমেছে। জানা গেছে, খুব শিগগিরই পাঁচটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা হবে। পাশাপাশি আরও ১১টি ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে ঘাটতিপূর্ণ ব্যাংকগুলোকে কার্যকর পরিকল্পনা জমা দিতে বলেছে। পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত না হলে কড়া প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে মোট বিতরণ করা ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত