ঢাকা, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
লাখ কোটি টাকার শিল্প চরম সংকটে, পাত্তা দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক
.jpg)
ডুয়া ডেস্ক: এক লাখ কোটি টাকার কাগজশিল্প চরম সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিসহায়তা না পাওয়া ও নানা প্রতিবন্ধকতায় এই খাতের ১০৬টি কারখানার মধ্যে ৭০টি বন্ধ হয়ে গেছে। চালু থাকা কারখানাগুলোতেও গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন সক্ষমতা কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সহায়তার সুপারিশ করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত নীরব ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল ৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি বাছাই কমিটি গঠন করেছে। তবে সেই কমিটির কার্যক্রম এখনও দৃশ্যমান নয়। কোনো প্রতিষ্ঠানকে এখন পর্যন্ত নীতিসহায়তার জন্য সুপারিশ করেনি কমিটি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে একাধিকবার চিঠি পাঠানো হলেও তাতে সাড়া মেলেনি। কাগজশিল্প সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এই খাতে সরাসরি প্রায় ২৫ লাখ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। এর সঙ্গে আরও ৩০০টি লিংকেজ শিল্প জড়িত। ৯ লাখ টনের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ১৬ লাখ টন উৎপাদনক্ষমতা থাকায় উদ্বৃত্ত পণ্য ৪০টি দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে।
কিন্তু বর্তমানে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, ডলার সংকট ও ঋণের জটিলতায় এই শিল্প দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এতে করে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারিয়েছে খাতটি।
উদ্যোক্তাদের ভাষ্য, নব্বইয়ের দশকে দেশীয় বড় শিল্প গ্রুপগুলোর বিনিয়োগের ফলে কাগজশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছিল। তাতে করে আমদানি নির্ভরতা কমলেও বর্তমানে চোরাচালান, মিথ্যা ঘোষণা ও বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাগজ খোলাবাজারে কম দামে বিক্রি হওয়ায় দেশীয় শিল্প হুমকিতে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়ে কাগজশিল্পে বিশেষ নীতিসহায়তার সুপারিশ করে। চিঠিতে শিল্পঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদ ও মূলধন ব্লক হিসাবে স্থানান্তর, এক বছরের মরাটোরিয়াম সুবিধাসহ ১০ বছরে পরিশোধের সুযোগ, ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ব্লক সুবিধা, কস্ট অব ফান্ড হারে সুদ নির্ধারণ এবং ছয় মাসের মধ্যে আবেদন জমা দেওয়ার সুযোগের মতো প্রস্তাব রাখা হয়।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই সুপারিশে ভিন্ন মত দিয়ে জানায়, আলাদা করে নীতিসহায়তা না দিয়ে বরং বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয় বিবেচনায় একটি বাছাই কমিটি কাজ করছে। তবে কমিটি জানিয়েছে, শতাধিক আবেদন জমা পড়লেও এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
কাগজশিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান নীতিগত বাধার কারণে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘একবার কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়ে গেলে, নীতিমালার কারণে তারা আর কাঁচামাল আমদানি করতে পারে না—এটি শিল্পোন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার ব্যাংকে যদি কারো ৫০০ কোটি টাকার ঋণ থাকে, তাহলে তাকে সম্পূর্ণভাবে অক্ষম করে দিলে সে কীভাবে সেই ঋণ পরিশোধ করবে? কাঁচামাল না আনতে পারলে উৎপাদন থেমে যাবে, তখন সে ঋণ শোধের পথও বন্ধ হয়ে যাবে। এই বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সব খেলাপিই যে ইচ্ছাকৃত, তা নয়। অনেকেই বাস্তব পরিস্থিতিতে পড়ে খেলাপি হয়েছে। তাদের আলাদা করে বিবেচনা করা দরকার।’
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি দেয় কাগজশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিবকে।
ওই চিঠিতে বলা হয়, কাগজশিল্পের বকেয়া ঋণের সুদ ও আসল সুদবিহীন ব্লক হিসাবে স্থানান্তরপূর্বক ঋণের কিস্তি দুই বছরের জন্য মরাটারিয়াম সুবিধা ও ১৫ বছরের জন্য পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে হ্রাসকৃত সুদে নতুন চলতি মূলধন ঋণ মঞ্জুর করার কথাও বলা হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পগুলোকে বিশেষ বিবেচনায় সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়েই রয়েছে। এখনো কারো ব্যাপারেই চূড়ান্ত কোনো সুপারিশ কমিটি থেকে করা হয়নি। এরই মধ্যে কয়েকজন গ্রাহকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। প্রাথমিক মিটিংগুলো শেষ হয়েছে। একে একে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগুলো এখন আসবে। এক হাজারেরও বেশি আবেদন পড়েছে। এগুলো সব যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা একটি কঠিন কাজ। ব্যাংক, গ্রাহক ও কমিটির মধ্যে আলোচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। কোনো কোনো পার্টির একাধিক ব্যাংকে ঋণ আছে।’
খুব শিগগিরই সিদ্ধান্ত আসবে বলেও জানান মুখপাত্র।
এ বিষয়ে পার্ল পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেডের পরিচালক (কমার্শিয়াল) রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কাগজ কারখানায় গ্যাস পাচ্ছি না। এতে উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। ধামরাইতে আমাদের কারখানায় দীর্ঘদিন ধরে গ্যাসের সমস্যা, কিন্তু এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ব্যাংক ঋণের সুদহার দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় পরিচালন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এতে কারখানা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।’
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) তথ্যানুযায়ী, দেশে ১০৬টি কাগজ মিলের মধ্যে গত তিন বছরে ৭০টির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস ও কাঁচামাল সংকটে বাকি ৩৬টি কারখানা চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কাগজশিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে ৩০০টির বেশি সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেছে।
বিপিএমএর সচিব নওশেরুল আলম বলেন, ‘দেশের কাগজ ও কাগজজাতীয় মিলগুলো মানসম্মত বিভিন্ন কাগজ উৎপাদন করছে। গ্যাস সংকট, এলসি সংকট ও কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়ায় কারখানায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেক কমেছে। এর সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিক্রি কমে যাওয়া, ঋণের উচ্চ সুদহার এবং ঋণখেলাপির নতুন সংজ্ঞার কারণে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে উদ্যোক্তাদের। অনেকে চলতি মূলধনের জোগান দিতে না পেরে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন। করোনা মহামারির পর থেকে একের পর এক সংকটে ৭০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।’
চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, জ্বালানিসংকট তথা গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, সংযোগ প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা, ঘন ঘন লোডশেডিংসহ নানা সমস্যা এই খাতকে লাভজনক শিল্পে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। সম্প্রতি জ্বালানির মূল্য প্রায় ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংক সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা কাগজশিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টেকসই স্থানে পৌঁছতে দিচ্ছে না।
দেশীয় কাগজশিল্প বর্তমানে চরম সংকটে রয়েছে, যার মূল কারণ কাঁচামালের আমদানিতে জটিলতা। কাগজ উৎপাদনের প্রধান উপাদান—ওয়েস্ট পেপার, পাল্প ও কেমিক্যালসের প্রায় ৭০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু বর্তমান তারল্য সংকটের কারণে কাগজ মিলগুলো প্রয়োজনীয় পাল্প আমদানি করতে পারছে না। ফলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নির্ধারিত সময়মতো কাগজ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিসহায়তা না পেলে সম্ভাবনাময় কাগজশিল্প খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে একদিকে যেমন হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে, তেমনি লক্ষাধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান ও জীবিকাও অনিশ্চয়তায় পড়বে।
শিল্প উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, ব্যাংক ঋণ পরিশোধে বিশেষ প্রণোদনা বা ছাড় না দেওয়া হলে অনেক প্রতিষ্ঠানই ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। এর ফলে কাগজশিল্পের পাশাপাশি সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সূত্র: কালের কণ্ঠ
পাঠকের মতামত:
সর্বোচ্চ পঠিত
- বিও হিসাবে ৫ লাখ টাকা নগদ জমা ও উত্তোলনের কথা ভাবছে বিএসইসি
- সরকারি কোম্পানি শেয়ারবাজারে আনার উদ্যোগ, তালিকায় ২১ প্রতিষ্ঠান
- ডিএসইর ব্রোকারেজ হাউজের নিবন্ধন বাতিল করল বিএসইসি
- বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ নিয়ে মুখ খুললেন অর্থ উপদেষ্টা
- ‘এলাম পরামর্শ নিতে, পেলাম পদত্যাগের বার্তা’- বিএসইসি চেয়ারম্যানের ক্ষোভ
- মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও পাবলিক রুলস ইস্যুতে টাস্কফোর্সের চূড়ান্ত সুপারিশ
- দশ হাজার কোটি ঋণের বোঝায় আইসিবি, প্রস্তাব বিশেষ তহবিলের
- দুর্বল ৬ শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের হতাশা আরও বেড়েছে
- শেয়ারবাজারের ৯ ব্যাংক এমডিবিহীন, নেতৃত্ব সংকট তীব্র
- ‘সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
- ঢাকা অচলের ঘোষণা
- তিন কোম্পানির বোনাস ডিভিডেন্ডে বিএসইসির সম্মতি
- লোকসান থেকে মুনাফায় বস্ত্র খাতের চার কোম্পানি
- নানামুখী চেষ্টার পরও ভেঙে পড়ছে দেশের শেয়ারবাজার
- শেয়ারবাজারে ৬১৭টি বিও হিসাব স্থগিত