ঢাকা, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
শেয়ারবাজার চাঙ্গা করতে ১০ হাজার কোটি টাকার ইকুইটি ফান্ডের প্রস্তাব
নিজস্ব প্রতিবেদক: অর্থ মন্ত্রণালয় গঠিত একটি উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি বাংলাদেশের স্থবির শেয়ারবাজারকে পুনরুজ্জীবিত করতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ এবং বহুমাত্রিক সুপারিশমালা পেশ করেছে। বাজারকে চাঙ্গা করতে এবং দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ফেরাতে, কমিটি ১০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তারল্য তহবিল এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য ভর্তুকিযুক্ত সুদে ঋণের উদ্দেশ্যে আরও ৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি, প্রতিবেদনে কর প্রণোদনা বৃদ্ধি (যেমন ১ লাখ টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ করমুক্ত রাখা ও মূলধনী আয়কর হ্রাস) এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ ৬০ শতাংশে উন্নীত করার মতো কাঠামোগত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও সমালোচকদের মতে, দেশের 'অনিশ্চিত' অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেবল তহবিল গঠন সহায়ক হবে না, তবুও এই প্রস্তাবনাগুলি বিএসইসি ও আইসিবির মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সংস্কার এবং ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের মাধ্যমে শেয়ারবাজারের গভীর ও টেকসই উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়ায় নীতি-নির্ধারকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
প্রতিবেদনটিতে শেয়ারবাজারের কাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শক্তিশালী করা, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) পুনর্গঠন এবং স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
এই সুপারিশগুলো সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন যে, বাজার উন্নয়ন ও কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোই তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরীকে প্রধান করে চলতি বছরের মার্চ মাসে চার সদস্যের এই কমিটি গঠিত হয়। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বিএসইসির কমিশনার ফারজানা লালারুখ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ সিদ্দিকী অবশ্য বর্তমান শেয়ারবাজারের সমস্যার জন্য দেশের 'অনিশ্চিত' অর্থনীতি এবং বিগত দুই বছরে নতুন বিনিয়োগের অভাবকে দায়ী করেছেন। তার মতে, স্থিতিশীল ও নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত তহবিল গঠন বা অর্থ বরাদ্দ বাজারের জন্য সহায়ক হবে না, কারণ বাজারের আস্থা নির্বাচিত সরকার এলেই দীর্ঘমেয়াদে বাড়বে।
তারল্য বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ তহবিল
কমিটির প্রস্তাব অনুসারে, শেয়ারবাজারে তারল্য বাড়াতে প্রস্তাবিত ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিলটি কেবল ইকুইটি বিনিয়োগে ব্যবহৃত হবে এবং এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে আইসিবি। পেশাদার পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপকদের মাধ্যমে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং একটি সাত সদস্যের তদারকি কমিটি (অর্থ মন্ত্রণালয়, আইসিবি ও স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে গঠিত) এর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করবে। পাশাপাশি, আইসিবির আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে এর পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য বর্তমানে চলমান ১ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিলটি আরও ২ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে মোট ৩ হাজার কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে তারা ৪ শতাংশ ভর্তুকিযুক্ত সুদে মার্জিন ঋণ পেতে পারে। তবে, আইসিবি নিজেই যেহেতু ঋণগ্রস্ত, সাবেক বিএসইসি চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ সিদ্দিকী সতর্ক করেছেন যে নতুন তহবিল আইসিবির হাতে দেওয়ার আগে এর অতীত পারফরম্যান্স পর্যালোচনা করা আবশ্যক।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও নীতি সমন্বয়
শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি মজবুত করার লক্ষ্যে, কমিটি স্টক ডিলার, মার্কেট মেকারসহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ ১২ বছরের মধ্যে বর্তমান ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করতে মূলধন সংগ্রহ সংক্রান্ত বিধিমালা সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে।
নীতিগত সংস্কারের অংশ হিসেবে, জাতীয় সঞ্চয়পত্র ও ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পের সুদের হারকে যৌক্তিক করতে ৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় মুনাফার সঙ্গে সমন্বয় করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো, সরকারি সঞ্চয় প্রকল্প থেকে বিনিয়োগকে শেয়ারবাজারের দিকে চালিত করা। পাশাপাশি, বিমা কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং বিএসইসি, বিআইসিএম ও বিএএসএমের মাধ্যমে দেশব্যাপী আর্থিক সাক্ষরতা কার্যক্রম জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে, ফারুক আহমদ সিদ্দিকীর মতে, ট্রেজারি বন্ডের চেয়ে লাভজনক রিটার্ন না পেলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে আকৃষ্ট হবেন না।
করপোরেট সুশাসন ও ফ্লোর প্রাইস বাতিল
বাজার স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ হিসেবে, কমিটি সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস পুরোপুরি বাতিল করার এবং আইপিওর পর প্রথম দিন থেকেই লেনদেন বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার সুপারিশ করেছে। এটি বাজারের স্বাভাবিক গতিশীলতা নিশ্চিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। করপোরেট সুশাসন জোরদার করতে, কোম্পানিগুলোর ঋণ গ্রহণের সীমা তাদের ইকুইটি ক্যাপিটালের ২৫০ শতাংশে বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে কোম্পানিগুলো ব্যাংকনির্ভরতা কমিয়ে শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহে উৎসাহিত হবে।
বাজার স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের তদারকির জন্য অর্থমন্ত্রী বা উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিএসইসি সহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি নিয়ন্ত্রক সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বছরে কমপক্ষে দুবার বৈঠক করবে।
'জেড' কোম্পানি এবং বিএসইসি পুনর্গঠন
কমিটি 'জেড' শ্রেণির কোম্পানিগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করতে তাদের পরিচালনা পর্ষদে অন্তত ৩০ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক রাখার জন্য করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড সংশোধনের সুপারিশ করেছে। যদি কোনো 'জেড' কোম্পানি দুই বছরের মধ্যে উচ্চতর শ্রেণিতে উন্নীত হতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে একজন স্বতন্ত্র পরিচালককে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের বিধান রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে শক্তিশালী করতে নীতি পর্যালোচনা, বাজার উন্নয়ন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের জন্য পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে এবং তাদের অপসারণের জন্য বিচারিক তদন্তের বিধান রাখা হয়েছে। বিএসইসি চেয়ারম্যানের মর্যাদা আপিল বিভাগের বিচারপতির এবং কমিশনারদের মর্যাদা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমতুল্য করার প্রস্তাবও রয়েছে। তবে ফারুক আহমদ সিদ্দিকী মনে করেন, শুধু সার্চ কমিটি যথেষ্ট নয়; রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও দক্ষ নেতৃত্বের নিয়োগই বাজারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাজার স্থবিরতার প্রধান কারণসমূহ
কমিটি শেয়ারবাজারের বর্তমান মন্দাবস্থার পেছনে আটটি মূল কারণ চিহ্নিত করেছে: দুর্বল মধ্যস্থতাকারী, ব্যাংকে উচ্চ সুদের হার, প্রণোদনা প্রত্যাহার, জাতীয় সঞ্চয়পত্রে উচ্চ মুনাফা, মূল্যস্ফীতি, আস্থার সংকট, ব্যাংকনির্ভর অর্থায়ন এবং মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে কম তহবিল সংগ্রহ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, উন্নত বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ৭০-৮০% হলেও বাংলাদেশে তা মাত্র ২০%। উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগকারীদের স্থায়ী আমানতের দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং খুচরা বিনিয়োগকারীদের ওপর কর আরোপ ও প্রণোদনা কমানোর ফলে বাজার আকর্ষণ হারিয়েছে। এছাড়াও, কারসাজি ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোতে সুশাসনের অভাবের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গভীর আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
সবশেষে, স্বল্প ইকুইটি থাকা সত্ত্বেও কোম্পানিগুলোর ব্যাংক থেকে সীমাহীন ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকার ফলে তারা শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহে উৎসাহিত হচ্ছে না, যা বাজারের দুর্বলতার প্রধান কারণ।
জুয়েল/
শেয়ারবাজারের বিশ্লেষণ ও ইনসাইড স্টোরি পেতে আমাদের পেজ ফলো করুন।
পাঠকের মতামত:
সর্বোচ্চ পঠিত
- আর্জেন্টিনা বনাম বাংলাদেশ আজকের খেলাটি সরাসরি (LIVE) দেখুন এখানে
- আর্জেন্টিনা বনাম বাংলাদেশ: ২ গোলে শেষ ম্যাচ, দেখুন ফলাফল
- যে কারণে বাতিল হলো আজকের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচ
- আর্জেন্টিনা বনাম বাংলাদেশ: খেলাটি সরাসরি (LIVE) দেখুন
- বাংলাদেশ বনাম আর্জেন্টিনা: ২৫ মিনিটে গোল-সরাসরি দেখুন
- মেডিকেল-ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত, এক ক্লিকেই জানুন ফলাফল
- আর্জেন্টিনা বনাম বাংলাদেশ: নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষ-দেখে নিন ফলাফল
- ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ১ম টি-20: যেভাবে দেখবেন সরাসরি (LIVE)
- আজ আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিলর ম্যাচ: সরাসরি দেখবেন যেভাবে
- কিছুক্ষণের মধ্যেই মেডিকেল ভর্তির ফল প্রকাশ, জানবেন যেভাবে
- আগামীকাল ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার ম্যাচ: কখন, কোথায়-সরাসরি দেখবেন যেভাবে
- লাতিন বাংলা সুপার কাপ: আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিলের খেলা নিয়ে যে সিদ্ধান্ত এলো
- অনলাইনে যেভাবে দেখবেন ২০২৫-২৬ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার ফল
- আজ দুপুরে মেডিকেল-ডেন্টাল ভর্তির ফল প্রকাশ, জানবেন যেভাবে
- বাংলাদেশ বনাম আর্জেন্টিনা: দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই গোল-দেখুন সরাসরি