ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

শেয়ারবাজারের নতুন সংকট আর্থিক প্রতিষ্ঠান: আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা

২০২৫ ডিসেম্বর ০২ ২১:৪৭:৫৬

শেয়ারবাজারের নতুন সংকট আর্থিক প্রতিষ্ঠান: আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক দিকে মোড় নিচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে ব্যাংক একীভূতকরণ, উচ্চ খেলাপি ঋণ, এবং আর্থিক খাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে বাজারে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা এনবিএফআই খাতের সাম্প্রতিক বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত সেই ভঙ্গুর অবস্থাকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক সংকেত থাকা সত্ত্বেও বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধসে পড়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা চরমভাবে নড়বড়ে হয়ে গেছে। এনবিএফআই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলুপ্তির প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হওয়ায় তাদের বিনিয়োগও ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে, আর বাজার জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন আতঙ্ক।

পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হওয়ার পরই বিনিয়োগকারীদের প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকার সম্পদ বাজার থেকে হারিয়ে যায়। তার ওপর নতুন করে আরও নয়টি এনবিএফআই, যার মধ্যে আটটি তালিকাভুক্ত, বিলুপ্তির পথে এগোনোয় সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা প্রায় ১,৪৫০ কোটি টাকার ক্ষতির ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।

এই ঘোষণার প্রভাব গতকাল (সোমবার) পুরো বাজারে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ৮৩ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে যায়। বিশেষ করে এনবিএফআই খাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে ৮৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর বড় ধস নামে। বিনিয়োগকারীরা দ্রুত শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করায় ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে চাপ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংক যে এনবিএফআইগুলোর বিরুদ্ধে বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলো হলো: ফাস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, প্রিমিয়ার লিজিং, ফার ইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। ঘোষণার পর এই কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগ শেয়ারের দাম ৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।

খুচরা বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে ভালো পারফর্ম করা এনবিএফআই-এর শেয়ারও বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাদের আশঙ্কা, বিলুপ্তির এ ধারায় পুরো খাতই আরও চাপের মুখে পড়তে পারে। ব্রোকাররা জানান, বিনিয়োগকারীরা ভয় পাচ্ছেন যে কয়েক মাস আগে ব্যাংক একীভূতকরণের সময় যে ধস নেমেছিল, এবারেও একই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

এদিকে, আগের ব্যাংক একীভূতকরণের পর ডিএসই-এর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স দুই সপ্তাহে প্রায় ৪০০ পয়েন্ট কমেছিল। এক সময় সূচক ৫,০০০ পয়েন্টের নিচে নেমে যায়। সাম্প্রতিক সপ্তাহে সামান্য ঘুরে দাঁড়ালেও এনবিএফআই বিলুপ্তির খবর বাজারকে আবার নিচের দিকে ঠেলে দেয়। গতকাল সূচক বন্ধ হয়েছে ৪,৯১৪ পয়েন্টে।

সংশ্লিষ্ট এনবিএফআইগুলোর শেয়ারহোল্ডারদের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হলো তাদের নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি)। আটটির মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানেরই এনএভি খুব বেশি ঋণাত্মক, অর্থাৎ তাদের সম্পদের চেয়ে দায় অনেক বেশি। ফলে সম্পদ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের পর সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের পাওয়ার মতো অর্থ থাকে না বললেই চলে। ২০২৩ সালের হিসাবে তালিকাভুক্ত আট এনবিএফআইয়ের মধ্যে শুধু প্রাইম ফাইন্যান্সের এনএভি ছিল সামান্য ইতিবাচক, প্রতি শেয়ারে ৫.৩১ টাকা।

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি বহু বছর ধরে তৈরি হয়েছে। ব্যাংক এবং এনবিএফআই থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বের করে নেওয়া, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, এবং খেলাপি ঋণের কারণে সংকট ঘনীভূত হয়।

এ ব্যাপারে সম্প্রতি ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর সভাপতি সাইফুল বলেন, "খেলাপি ঋণ এত বড় হয়ে গিয়েছিল যে পুনর্গঠনের সুযোগই আর ছিল না। এখন বিলুপ্তির সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।"

তিনি বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের আর্থিক বিবরণীতে প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন দেখায়নি। অডিটর ও ক্রেডিট রেটিং সংস্থাগুলোকেও দায় নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষে এনবিএফআই খাতে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২৫,০৮৯ কোটি টাকা। এর ৫২ শতাংশ শুধু এই আট প্রতিষ্ঠানের। খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৭৩.৫ শতাংশ রয়েছে মাত্র ১২টি প্রতিষ্ঠানে। গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০টি এনবিএফআইকে হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে "রেড ক্যাটাগরি"তে রেখেছিল এবং কেন তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে না, তার ব্যাখ্যা দিতে বলেছিল। নয়টি প্রতিষ্ঠান সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় তারা এখন বিলুপ্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

এমজে/

শেয়ারবাজারের বিশ্লেষণ ও ইনসাইড স্টোরি পেতে আমাদের পেজ ফলো করুন।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত