ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫, ২৩ আশ্বিন ১৪৩২

শেয়ারবাজার থেকে ৫-১০ কেজি কাগজের আইপিও প্রক্রিয়া বন্ধ জরুরী

আবু তাহের নয়ন
আবু তাহের নয়ন

সিনিয়র রিপোর্টার

২০২৫ অক্টোবর ০৯ ০০:০৮:৪৪

শেয়ারবাজার থেকে ৫-১০ কেজি কাগজের আইপিও প্রক্রিয়া বন্ধ জরুরী

আবু তাহের নয়ন: দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী কোম্পানিগুলোকে এখনও ৫ থেকে ১০ কিলোগ্রাম ওজনের ফাইল-ভিত্তিক, অত্যন্ত জটিল ও পুরোনো কাগজের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়—যা শেষ হতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় নিতে পারে। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সেকেলে ব্যবস্থাটি সময়সাপেক্ষ, জটিল এবং বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। তাদের মতে, এর একমাত্র কার্যকর সমাধান হলো পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালকরণ।

বুধবার (০৮ অক্টোবর) রাজধানীতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কার্যালয়ে ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টর উইক-এর অংশ হিসেবে আয়োজিত "উদীয়মান প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ফাইন্যান্সের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের ক্ষমতায়ন" শীর্ষক এক সেমিনারে এসব পর্যবেক্ষণ উঠে আসে। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন।

দীর্ঘসূত্রিতা: আইপিও প্রক্রিয়ায় ৫-১০ কেজি কাগজ

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে ঢাকা ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ)-এর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারে দক্ষতা বাড়াতে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল করা অপরিহার্য। তিনি বলেন, "এখনও আইপিও অনুমোদনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর মধ্যে ৫ থেকে ১০ কেজি ওজনের ফাইল আদান-প্রদান হয়। আমরা আর এমন কাগজপত্র দেখতে চাই না। প্রক্রিয়াটি অবশ্যই ডিজিটাল করতে হবে।" তিনি আরও মন্তব্য করেন, "পাশের দেশগুলোর মতো আমাদেরও স্বল্প সময়ের মধ্যে আইপিও প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কোনো আইপিও বাজার দেড় থেকে দুই বছর ধরে নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো নজির নেই। এমন অবস্থায় শেয়ারবাজার টেকসইভাবে চলতে পারে না।"

সাইফুল ইসলাম আইপিও অনুমোদনের জন্য একটি একক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। এই প্ল্যাটফর্মে বিএসইসি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), ডিএসই এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সহ সকল নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরাসরি কোম্পানির জমা দেওয়া নথিগুলো যাচাই করতে পারবে। তিনি যোগ করেন, "কোম্পানিগুলো তাদের নথি অনলাইনে আপলোড করবে, যার ফলে নিয়ন্ত্রকরা সেগুলো ডিজিটালভাবে পর্যালোচনা করতে পারবেন। এতে সময় বাঁচবে, খরচ কমবে এবং অপ্রয়োজনীয় জটিলতা দূর হবে।"

তথ্য-স্বচ্ছতার অভাব বড় চ্যালেঞ্জ

ডিবিএ সভাপতি উল্লেখ করেন, যদিও ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় ধরনের বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, তবুও ডিএসই-এর মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন কমেছে। তিনি রিয়েল-টাইম তথ্যের সীমিত প্রবেশাধিকার, কম আর্থিক জ্ঞান এবং ভুল তথ্য ও ডিজিটাল প্রতারণার ঝুঁকিগুলোকে চিহ্নিত করে বিনিয়োগকারীরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হচ্ছেন, তা সমাধানের আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, ডেটা অ্যানালেটিক্স এবং রোবো-অ্যাডভাইজরের মতো উদীয়মান প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজারকে রূপান্তরিত করছে, কিন্তু বাংলাদেশে এর কার্যকর ব্যবহারের জন্য সকল পর্যায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

'অনিয়মকারীদের খেলার মাঠ' ও নীতিমালার সমস্যা

অনুষ্ঠানে আইসিএমএ বাংলাদেশের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ সতর্ক করে বলেন, নীতি প্রণয়নে অসামঞ্জস্যতার কারণে বাজারটি "অনিয়মকারীদের খেলার মাঠে" পরিণত হয়েছে। তিনি দুর্বল প্রয়োগ, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে লেনদেন (related-party transactions) এবং স্বাধীন পরিচালকদের অকার্যকর ভূমিকাকে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, ডিজিটাল নজরদারি এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।

বিএসইসি কমিশনারের আশ্বাস ও সতর্কবার্তা

বিএসইসি কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন প্রযুক্তিগত উদ্যোগে অগ্রগতি হওয়ার কথা স্বীকার করেন। তবে তিনি উল্লেখ করেন যে এক্সচেঞ্জ, সিডিবিএল এবং সিএসই-এর মতো মূল স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে সফলতা সীমিত হচ্ছে। তিনি একটি ডিজিটাল বিনিয়োগ ইকোসিস্টেম গড়তে সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন।

তিনি বলেন, "একটি সমন্বিত বিনিয়োগ কাঠামো গড়তে হলে আমাদের প্রথমে বর্তমান পরিস্থিতি, প্রযুক্তিগত ঘাটতি এবং কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো বুঝতে হবে।" তিনি আরও বলেন, "তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব এখনও বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ।"

তিনি উল্লেখ করেন, বিএসইসি সম্প্রতি আইএফআরএস মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এক্সটেন্ডেড বিজনেস রিপোর্টিং ল্যাঙ্গুয়েজ (এক্সবিআরএল) চালু করেছে, যা গবেষণা, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণকে সহজ করবে। তবে এর সফলতা নিরীক্ষক (অডিটর) এবং বাজারের অংশগ্রহণকারীদের সহযোগিতার ওপর নির্ভর করবে বলে তিনি জোর দেন। বাজারের প্রবণতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সাইফুদ্দীন সতর্ক করে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিপরীতে বাজারে অংশগ্রহণ কমছে, সম্পদ বৈষম্য বাড়ছে এবং বাজারের সামগ্রিক আকার প্রতি বছর প্রায় ৩ শতাংশ হারে সংকুচিত হচ্ছে। তিনি বলেন, "এখন যৌথ দায়িত্বের সময়। প্রযুক্তি আমাদের সিস্টেম পুনর্গঠন এবং বাজারের কাঠামো পরিবর্তনের একটি অনন্য সুযোগ দিচ্ছে।"

ডিএসই চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মমিনুল ইসলামও একই সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, দেশে প্রযুক্তির অগ্রগতি সত্ত্বেও শেয়ারবাজার এখনও এর সঠিক সুবিধা নিতে পারেনি। তিনি বলেন, "আমাদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি দুর্বল, এমনকি সামান্য তথ্যের জন্যও এখনও ব্রোকারদের চিঠি পাঠাতে হয়। বাজারকে যত বেশি ডিজিটাল করা হবে, তা তত বেশি নির্ভুল এবং স্বচ্ছ হবে। এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।"

অনুষ্ঠানে অন্যান্য বিশিষ্টজনদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ডিএসইর চেয়ারম্যান এ কে এম হাবিবুর রহমান এবং ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আসাদুর রহমান; সিডিবিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল মুতালেব; সিএসই-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শাইফুর রহমান মজুমদার; এবং সিএফএ সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি আসিফ খান।

এএসএম/

শেয়ারবাজারের বিশ্লেষণ ও ইনসাইড স্টোরি পেতে আমাদের পেজ ফলো করুন।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত