ঢাকা, সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭ ভাদ্র ১৪৩২

টানা দরপতনে পাঁচ ব্যাংক, আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা

মোবারক হোসেন
মোবারক হোসেন

সিনিয়র রিপোর্টার

২০২৫ সেপ্টেম্বর ০১ ১১:৩৮:২৫

টানা দরপতনে পাঁচ ব্যাংক, আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা

মোবারক হোসেন: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে টানা দরপতনের শিকার হয়েছে, যা বাজারে নতুন এক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর একের পর এক নিম্নমুখী হতে থাকায় বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে বিক্রির পথে হাঁটছেন। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে দীর্ঘদিনের মূলধন ঘাটতি, বাড়তে থাকা অনাদায়ী ঋণ এবং আমানতের সংকট। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি সামাল দিতে একীভূতের উদ্যোগ নিলেও, স্থিতি ফেরানোর বদলে এই পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের মনে আরও বেশি অনিশ্চয়তা ও অবিশ্বাস তৈরি করেছে।

বর্তমানে এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এমন অবস্থায় বাজারে তাদের অবস্থান সবচেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন, একীভূত হওয়ার পর তাদের হাতে থাকা শেয়ারের ভবিষ্যৎ মূল্য অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ফলে আতঙ্কে অনেকে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন, যা দরপতনের গতি আরও বাড়াচ্ছে।

গত এক মাসে শরিয়াহ্‌ভিত্তিক এই পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারদরে বড় ধস নেমেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। ২৮ জুলাই যেখানে প্রতি শেয়ার ৮ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হচ্ছিল, তা নেমে এসেছে ৫ টাকা ৫০ পয়সায়—অর্থাৎ প্রায় ৩৫ শতাংশ পতন। এরপর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদরও কমেছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, ৪ টাকা ৫০ পয়সা থেকে নেমে ৩ টাকায় এসেছে।

এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৬ টাকা ৫০ পয়সা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৪০ পয়সায়, যা ৩২ শতাংশের বেশি পতন। অন্যদিকে গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক উভয়ের শেয়ারদর ৩ টাকা ১০ পয়সা থেকে নেমে ২ টাকা ৪০ পয়সায় এসেছে—যেখানে পতনের হার ২২ শতাংশের বেশি।

শেয়ারদর টাকার হিসেবে তুলনামূলক কম মনে হলেও, যেহেতু এসব শেয়ারের দাম আগে থেকেই নিম্ন স্তরে ঘোরাফেরা করছে, তাই কয়েক পয়সার পতনও শতাংশের হিসাবে বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই কারণে বাজারে আতঙ্ক আরও বাড়ছে।

শেয়ারবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, ব্যাংকগুলো একীভূত হলে বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। কোন মূলধনি শেয়ার কী হারে রূপান্তরিত হবে—এমন অনিশ্চয়তার কারণে অনেকে এখনই শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন, যদিও তাতে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, "একীভূত হয়ে গেলে এসব ব্যাংকের শেয়ার আর তালিকাভুক্ত থাকবে না। তাই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক স্বাভাবিক।"

বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটসের মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী মনে করেন, ব্যাংকগুলোতে নতুন আমানত আসছে না, বরং বিদ্যমান আমানতকারীরাও টাকা তুলছেন। এতে বিনিয়োগকারীদের ধারণা তৈরি হয়েছে, এসব ব্যাংক হয়তো টিকবে না। ফলে যত দামেই হোক, শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, প্রকৃতপক্ষে এসব ব্যাংকের দায় সম্পদের চেয়ে বেশি। তাই অভিহিত মূল্যের নিচে শেয়ারদর নেমে যাওয়া স্বাভাবিক। বাস্তবে এসব ব্যাংকের শেয়ারের কোনো মূল্য থাকার কথা নয়; কারণ এগুলো ঋণাত্মক সম্পদে চলছে। একীভূত হওয়ার পর সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

ফলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকারে ঢাকা রয়েছে। প্রতিদিন দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন, অথচ সামনের দিনে ব্যাংকগুলো টিকে থাকবে নাকি একীভূতের পর তাদের অস্তিত্ব হারাবে—সে প্রশ্নের জবাব কেউ স্পষ্টভাবে দিতে পারছেন না। এতে অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার ধরে রাখার সাহস হারিয়ে ফেলছেন, আবার কেউ কেউ লোকসান মেনেও বিক্রি করে দিচ্ছেন। ক্রমবর্ধমান এই দুশ্চিন্তা বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা থেকে উত্তরণের সুস্পষ্ট কোনো পথ এখনো দৃশ্যমান নয়।

এ পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা এবং একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার রূপরেখা সঠিকভাবে জানানো জরুরি। বিএসইসি চাইলে ব্যাংকগুলোর শেয়ারের লেনদেনে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করতে পারে, যাতে অযাচিত গুজব ও আতঙ্ক কমে আসে এবং বাজারে একটি ন্যূনতম স্থিতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।

এএসএম/

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

সর্বোচ্চ পঠিত