ঢাকা, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২

যৌন আঘাতে ভেঙে পড়ে নারীর মস্তিষ্ক

ইনজামামুল হক পার্থ
ইনজামামুল হক পার্থ

রিপোর্টার

২০২৫ অক্টোবর ১৫ ১৪:০৬:৫০

যৌন আঘাতে ভেঙে পড়ে নারীর মস্তিষ্ক

ইনজামামুল হক পার্থ: ঘর, রাস্তা, অফিস কিংবা গণপরিবহন নারীরা যেন কোথাও নিরাপদ নন। সমাজের প্রতিটি স্তরে যৌন হেনস্থা আজ এক অদৃশ্য ছায়ার মতো নারীদের ঘিরে রেখেছে। কখনো তা শারীরিক আকারে, কখনো মানসিক যন্ত্রণায় প্রকাশ পায়। অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, অশালীন মন্তব্য, বাজে ইশারা, কু-চাহনি বা দেহ নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য সবই যৌন হেনস্থার আওতায় পড়ে। এই অভিজ্ঞতা শুধু শরীরে নয়, গভীর ক্ষত রেখে যায় মনের ভেতরও যা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারে না।

প্রতিদিন অসংখ্য নারী এমন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে আসে, কিন্তু অধিকাংশই থেকে যায় নীরব অন্ধকারে। এই নীরব সহিংসতার মানসিক অভিঘাত থেকে অনেক নারী আর ফিরে আসতে পারেন না স্বাভাবিক জীবনে। ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতি তাদের মস্তিষ্কে দীর্ঘদিন দাগ রেখে যায়, ভেঙে দেয় আত্মবিশ্বাস ও মানসিক ভারসাম্য। গবেষণায় দেখা গেছে, এই মানসিক আঘাত নারীদের জীবনের ছন্দ, কর্মক্ষমতা ও মানসিক সুস্থতাকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

স্পেনের বার্সেলোনার Hospital Clínic-IDIBAPS–এর গবেষকরা সম্প্রতি উদ্ভাবনী গবেষণায় দেখিয়েছেন যে যৌন সহিংসতার শিকার মহিলাদের মস্তিষ্কে আবেগ নিয়ন্ত্রণের দুটি কেন্দ্র, অ্যামিগডালা ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের মধ্যে যোগাযোগ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যায়। এক উপসর্গ হচ্ছে PTSD (পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার) – যা প্রায় ৭০% পুরুষ সন্তানহারা নারীদের মধ্যে দেখা যায়। এই অসুখে ভুক্তভোগীরা তীব্র ভয়, উদ্বেগ, আতঙ্কজনিত স্মৃতি, ঘুমে দুঃস্বপ্ন, মনোভাবের বিঘ্ন এবং অতিসতর্ক অবস্থা অনুভব করেন। যৌন সহিংসতা পরবর্তী PTSD হয়ে থাকলে হতাশা, উদ্বেগ ও আত্মহত্যার ভাবনা আরও প্রবল হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে এই ধরনের PTSD-তে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে প্রতিরক্ষামূলক প্রাণতন্ত্র এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশের সহযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে দৈনন্দিন কাজেও বিঘ্ন ঘটে। সংক্ষেপে, শারীরিক বা মানসিক যৌন হয়রানির পর মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ সার্কিটে পরিবর্তন ঘটে এবং ভুক্তভোগী নারীরা দীর্ঘসময় প্রচণ্ড মানসিক কষ্টে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

PTSD-এর চিকিৎসা ও পরামর্শ

PTSD-সহ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রধান চিকিৎসা হলো কথোপকথন থেরাপি (সাইকোথেরাপি) এবং প্রয়োজনে ওষুধ। Mayo Clinic-এর মতে, PTSD-র প্রধান চিকিৎসা হলো বিভিন্ন ধরনের সাইকোথেরাপি। এর মধ্যে অন্যতম হল এক্সপোজার থেরাপি (Exposure Therapy) যা শিকারদের ভয় ও স্মৃতির সঙ্গীন ঘটনার মুখোমুখি হতে সহায়তা করে। এছাড়া কগনিটিভ থেরাপি (Cognitive Therapy) প্রয়োগ করে নেতিবাচক চিন্তা চেনে নিয়ে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়। থেরাপিস্টরা শিথিলায়ন, বিশ্রাম ও ব্যায়াম–সহ বিভিন্ন স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কৌশল শেখান যাতে করে শিকারীরা নিজেকে শান্ত রাখতে পারেন।

কাউন্সেলিং ও থেরাপির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় চিকিৎসায় ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে। PTSD রোগে সাধারণত রোগীর বিষণ্নতা ও উদ্বেগ কমাতে এসএসআরআই ঔষধ (যেমন সেরট্রালিন, প্যারক্সেটিন) প্রাথমিক স্তরে প্রয়োগ করা হয়। কিছু ক্ষেত্রেই শারীরবৃত্তীয় ঘুমজনিত সমস্যা কমাতে অন্য ঔষধ (যেমন ভেনলাফাক্সিন) দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া ভয়জনিত স্মৃতির জন্য গবেষণায় প্রস্তাবিত কিছু বিশেষ পদ্ধতি (যেমন নেকের নিকটে নড়া স্নায়ুতে ইনজেকশন) রয়েছে, তবে সেগুলো এখনও অনুমোদিত নয়। সাধারণ পরামর্শ হচ্ছে একজন অভিজ্ঞ মনোবিদের মাধ্যমে ব্যক্তিগত বা গ্রুপ থেরাপি করতে হবে – কারণ অনুরূপ অভিজ্ঞতা শেয়ার করা মানসিক সান্ত্বনা এনে দিতে পারে। এই সকল চিকিৎসা ও পরামর্শ মিলে PTSD থেকে নড়েচড়ে ওঠার পথ সুগম করে।

সহায়তা কেন্দ্র: বাংলাদেশে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠন করেছে Victim Support Center (VSC), যেখানে ২৪ ঘণ্টা আইনগত সহায়তা, চিকিৎসা, আশ্রয় এবং কাউন্সেলিং প্রদান করা হয় dmpwsid.gov.bd। বর্ণিত সেন্টারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও যেমন Ain o Salish Kendra, BNWLA, নারীপক্ষ ইত্যাদি ভুক্তভোগী নারীদের মানসিক ও আইনি সহায়তা করে থাকে। এগুলোতে ফরেনসিক পরামর্শ, থেরাপি সেশন এবং পুনর্বাসন কর্মশালার ব্যবস্থা থাকে।

বাংলাদেশে যৌন হয়রানির পরিসংখ্যান

বাংলাদেশে নারীরা ব্যাপক মাত্রায় যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল উইমেন্স লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (BNWLA) তথ্য অনুসারে দেশে প্রায় ৮৪% নারী বিভিন্ন সময়ে পথে, গণপরিবহণে, কর্মক্ষেত্রে বা ঘরেই যৌন হয়রানির শিকার হয়। গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে করা একটি BRAC সমীক্ষা দেখিয়েছিল ৯৪% নারী চলন্ত বাস-ট্রেনে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। পোশাকখাতের নারী শ্রমিকদের উপর করা গবেষণায় পাওয়া গেছে ২২% শ্রমিক অন্তত একবার হয়রানির শিকার। করোনাকালীন সময়ে ঢাকার অফিস-কলেজের ১৩৫ জন নারীর জরিপে দেখা গেছে সবাই কিছু না কিছু যৌন হয়রানির মুখোমুখি হয়েছেন। সাম্প্রতিক BBS/UNFPA জরিপ জানিয়েছে, দেশে ৪ প্রতি ৩ নারী জীবনের কোনো পর্যায়ে কোন না কোন রূপের সহিংসতার (শারীরিক, যৌন বা মানসিক) শিকার। অতীতে বা সাম্প্রতিক সময়ে অ-স্বামী বা অপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা শারীরিক/যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন এমন নারীর হার ১৫%, যা প্রায় ৩০ লক্ষ নারী-মেয়েকে প্রভাবিত করেছে। এই তথ্যগুলো থেকে অনুমেয় যে যৌন হয়রানির সমস্যাটি দেশে কী পরিমাণ গভীর।

আইন ও উদ্যোগ: আন্তর্জাতিক ও দেশীয়

বাংলাদেশে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বিভিন্ন আইন এবং উদ্যোগ চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এখনও চূড়ান্ত করেনি “কর্মস্থল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন”; নারী সংগঠন “জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম” দ্রুত এ আইন গেজেটে নোটিফাই করার দাবি জানিয়েছে। আরও পদক্ষেপ হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)–এর কনভেনশন ১৯০ (কার্যক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধ)ratify করার আহ্বান উঠেছে। কমিউনিটি পর্যায়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের Victim Support Center (VSC) ২০০৯ সাল থেকে ভুক্তভোগীদের আইনি ও সামাজিক সহায়তা দিয়ে আসছে dmpwsid.gov.bd। উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় ক্যাম্পাস ও অফিসে হেনস্থার অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্র চালু হয়েছে। এছাড়া নারীর অধিকার রক্ষায় মোটামুটি শক্ত আইন: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এবং গৃহস্থালির সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ রয়েছে, যদিও এই আইনে মূলত স্ত্রীর উপর স্বামীর নির্যাতন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আন্তর্জাতিক স্তরে UN Women-এর মতো সংস্থা দেশে সচেতনতা বাড়াচ্ছে এবং যৌন হয়রানি বাদ দিয়ে নারী নিরাপত্তায় নানা প্রকল্প চালাচ্ছে।

গবেষণা ও প্রচার: সরাসরি যৌন হয়রানির ভয়াবহতা তুলে ধরতে নানা সংস্থা নিয়মিত জরিপ করে। যেমন BNWLA ও অ্যাস্ক-এর রিপোর্ট, UNFPA/BBS-এর VAW জরিপ ইত্যাদিতে এই সমস্যা প্রতিফলিত হয়।

আইনি উদ্যোগ: ‘MeToo’–এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি বেড়েছে। ইসলামি আইনসহ অন্যান্য আন্তরিক কোর্সেও এই বিষয়ে সংশোধনী আনা হচ্ছে।

পুনর্বাসন কর্মসূচি: বিভিন্ন এনজিও ও সমাজকল্যাণ কেন্দ্র যৌন হয়রানির শিকার নারীদের জন্য ত্রৈমাসিক প্রশিক্ষণ ও আর্থ-সামাজিক সহায়তার উদ্যোগ নিয়ে থাকে। পুলিশি স্তরে VSC ছাড়াও নারীর কল্যাণ কেন্দ্র আর DMP মহিলা ও শিশু বিভাগ ভুক্তভোগীকে সহায়তা দেয়।

উপরোক্ত গবেষণা ও পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দিচ্ছে: যৌন হয়রানি শুধু একক ঘটনা নয়, বরং নারীদের স্বাভাবিক জীবন, কর্মক্ষমতা ও মানসিক সুস্থতায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। স্বাস্থ্যের যত্নশীল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌন ট্রমার পর সমন্বিত চিকিৎসা জরুরি - যথাযথ থেরাপি, ঔষধ এবং সামাজিক সহায়তা মিলে পূর্ণ পুনর্বাসন সম্ভব। বাংলাদেশে এ বিষয়ে আইনি সংস্কার ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণই এখন অপরিহার্য।

ইএইচপি

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত