ঢাকা, শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫, ৮ ভাদ্র ১৪৩২

ছাত্র সংসদ নির্বাচন: বিশ্ববিদ্যালয় যেন রক্ষার চাবিকাঠি হয়

ডুয়া নিউজ- জাতীয়
২০২৫ আগস্ট ২৩ ১৮:৫২:১৭
ছাত্র সংসদ নির্বাচন: বিশ্ববিদ্যালয় যেন রক্ষার চাবিকাঠি হয়

এটিএম আবদুল বারী ড্যানী: দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে, যা দেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। এই নির্বাচনকে কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে না দেখে, বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের পুরোনো গৌরব ফিরিয়ে আনার একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদি নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় এবং শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে তাদের নেতৃত্ব বেছে নিতে পারে, তাহলে তা ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

বর্তমানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা সংকটে জর্জরিত। সেশন জট, ক্লাস-পরীক্ষার অনিয়ম, শিক্ষার নিম্নমান এবং প্রায়শই ঘটে যাওয়া ক্যাম্পাস সহিংসতার কারণে শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন। একসময় এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি যে জনআস্থা ছিল, তা আজ অনেকটাই কমে গেছে। এই পরিস্থিতির মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করে একটি টেকসই সমাধানের পথ খুঁজে বের করা জরুরি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস থেকে দেখা যায়, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষার মান এবং পরিচালন ব্যবস্থা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষক ও উপাচার্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়শই মেধার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে ও আবাসিক হলগুলোতে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে চায়, যা প্রায়শই সহিংসতা এবং বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। যার ফলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এবং মৌলিক একাডেমিক পরিবেশ নষ্ট হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আরেকটি বড় সমস্যা হলো শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত আয়ের জন্য সান্ধ্য ও সাপ্তাহিক কোর্স চালু করা হয়েছে এবং শিক্ষকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন কাজ করছেন। এতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের নিয়মিত ক্লাসগুলোতে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত মনোযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই বাণিজ্যিকীকরণ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

নব্য-উদারনৈতিক নীতি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এখন পাণ্ডিত্য ও গবেষণার পরিবর্তে আর্থিক লাভের দিকে বেশি ঝুঁকছে। শিক্ষকদের অনেকেই ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনে ব্যস্ত, আর ছাত্র নেতারা চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। সরকারও প্রায়শই অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগ করে, যা একাডেমিক অগ্রগতির চেয়ে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে।

এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ছাত্র রাজনীতিকে গঠনমূলক ও দায়িত্বশীল ধারায় ফিরিয়ে আনা অপরিহার্য। ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল ক্ষমতার লড়াইয়ের প্ল্যাটফর্ম না হয়ে, বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবক্ষয় থেকে রক্ষা করার একটি হাতিয়ার হওয়া উচিত। এই নির্বাচন হতে হবে আদর্শভিত্তিক, যেখানে যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসবে।

ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও প্রশাসনিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ওপর জোর দিতে হবে, রাজনৈতিক আনুগত্যের ওপর নয়। ছাত্র সংগঠনগুলোকে অবশ্যই চাঁদাবাজি, সহিংসতা বা অন্যায় কাজে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও, শ্রেণি, লিঙ্গ, ধর্ম ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের মূল লক্ষ্য—শিক্ষা, গবেষণা ও মুক্ত চিন্তার কেন্দ্র—ফিরিয়ে আনতে হবে।

যদি আসন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচন এই পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে, তাহলে তা দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং পুরো সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং একটি দায়িত্বশীল সরকারের সদিচ্ছাই কেবল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে দিতে পারে।

লেখক: ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত