ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ৮ কার্তিক ১৪৩২

আওয়ামী শাসনের ইসলামবিদ্বেষ নিয়ে আলোচনায় ‘প্রজেক্ট ঊনমানুষ’

২০২৫ অক্টোবর ২৩ ১১:৫৪:৩১

আওয়ামী শাসনের ইসলামবিদ্বেষ নিয়ে আলোচনায় ‘প্রজেক্ট ঊনমানুষ’

নিজস্ব প্রতিবেদক :২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের একটানা সাড়ে ১৫ বছরের শেখ হাসিনা সরকারের দুঃশাসনের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে বাংলাদেশে ইসলামোফোবিয়া বা ধর্মবিদ্বেষমূলক এক সংস্কৃতি তৈরি করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, সেখানে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলা শিক্ষার্থীদের হেয় করা, কখনও জঙ্গি আখ্যা দেওয়া এবং প্রশাসনিকভাবে বৈষম্য করার এক ভয়াল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি হল দখল, সিট বাণিজ্য, গুম, খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর দমননীতি চালানো হয় সরকারদলীয় ছাত্রলীগের মাধ্যমে। শিক্ষার্থীদের সাথে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনাগুলো তুলে ধরে অনলাইন গণমাধ্যম দ্যা ঢাকা ডায়েরি।

সোমবার (২০ অক্টোবর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ‘প্রজেক্ট ঊনমানুষ’ শিরোনামে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করে নিউজ পোর্টালটি।

প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে বিগত সরকারের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামবিদ্বেষ, ধর্মীয় চর্চাকারী শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্য, প্রশাসনিক বাধা ও সহিংস নির্যাতনের বিবরণ।

প্রামাণ্যচিত্রে রয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের দুঃশাসনের সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে বাংলাদেশে ইসলামোফোবিয়া বা ধর্মবিদ্বেষমূলক এক সংস্কৃতির শিকার হওয়া শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ঘটনা।

প্রামাণ্যচিত্রটির সার-সংক্ষেপ তুলে ধরা হলো:

শ্রেণিকক্ষের বৈষম্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমিনা তামান্না বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাসেই এক শিক্ষক তার পোশাক নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন, যা তাকে মানসিকভাবে গভীরভাবে আঘাত করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শরিফ ওসমান হাদির ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা। দাড়ি ও টুপি থাকার কারণে তাকে ‘হেফাজত' নামে ডাকা হতো। সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও আওয়ামীপন্থী শিক্ষক নেতা ড. জিনাত হুদা নিকাব পরা শিক্ষার্থীদের ‘চিহ্নিত’ করে রাখতেন। এমনকি ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক শিক্ষক বোরকাকে ‘নাইট ড্রেস’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

পরীক্ষা ও ভাইভায় হয়রানি

পরীক্ষার সময় হিজাব-নিকাব পরা শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র না দেওয়া, পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেওয়া, এমনকি ভাইভা বোর্ডে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন বাদ দিয়ে পোশাক নিয়ে প্রশ্ন করা—এসব অভিযোগও এসেছে প্রামাণ্যচিত্রে। অনেক শিক্ষার্থী ধর্মীয় পোশাকের কারণে ফলাফলেও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।

হলজীবনে নির্যাতন

মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিবির কর্মী শাহ রিয়াদ নামাজ ও ইসলামি অনুশাসন পালনের কারণে ছাত্রলীগের নজরদারিতে ছিলেন। এক পর্যায়ে ধর্মীয় কথোপকথনকে কেন্দ্র করে তাকে রাতভর নির্যাতনের পর হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এমনকি নামাজ পড়তেও বাধা দেওয়া হয়। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আবু বকরও দাড়ি ও টুপি রাখায় ‘শিবির’ ট্যাগ পান এবং ভয়ে আর হলে উঠতে পারেননি।

ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হামলা

২০২৪ সালে রমজান মাসে আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের আয়োজিত ‘প্রোডাক্টিভ রমাদান’ আলোচনায় সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এতে একাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। একই বছর বটতলায় কুরআন তেলাওয়াত অনুষ্ঠানের পর শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন তৎকালীন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আব্দুল বাছির।

শেখ হাসিনার নির্দেশে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণইফতারের আয়োজন করলে ছাত্রলীগ তা ঠেকাতে হামলা ও বাধা দেয়। অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনকে গণইফতারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতেও বাধ্য করা হয়। আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল জাওয়াদ কুরআন তেলাওয়াত করায় উপাচার্যের বাসায় তারাবির ইমামতির দায়িত্ব হারান এবং ছাত্রলীগের হামলার ভয়ে হল ছাড়তে বাধ্য হওয়া ঘটনা উল্লেখ করা হয় প্রামাণ্যচিত্রে।

প্রশাসনিক ও একাডেমিক বাধা

ছাত্রলীগের চাপে হাফেজ সম্মেলনের জন্য অডিটোরিয়ামের অনুমতি বাতিল করে প্রশাসন একই স্থানে অন্য অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেয়। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও গবেষণার ক্ষেত্রেও মাদরাসা-পটভূমির শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্য চলত। শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে অনেক সময় ‘মাদরাসায় পড়া’কে অযোগ্যতা হিসেবে দেখা হতো।

প্রকাশ্যে ইসলামবিদ্বেষ

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও আওয়ামীপন্থী শিক্ষক নেতা সাদেকা হালিম নামাজের বিরতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘তালেবানি রাষ্ট্র’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। অনেক শিক্ষক প্রকাশ্যে ইসলামী পোশাক পরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিদ্রূপ করেছেন। এমনকি ছাত্রলীগ নেতারা সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ফজলুল হক মুসলিম হলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়েছিলেন।

বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তভোগীদের অভিমত

লোক প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শেহরিন আমীন ভূইয়া বলেন, “ধর্ম চর্চার কারণে বৈষম্য বা হেনস্তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। গত ১৫ বছর আওয়ামী সরকার ধর্মকে দুর্বৃত্তায়ন করেছে।” আরবি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহাদী হাসান বলেন, “ইসলামি চর্চার সঙ্গে সম্পৃক্তদের গৌণ ভাবার প্রবণতা ধীরে ধীরে কমছে। তবে অভিযোগের তদন্তে ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করতে হবে।”

তবে এ প্রতিবেদনের শেষে পরিবর্তনের আশার বার্তা রয়েছে-

অধ্যাপক শেহরিন আমীন ভূইয়া বলেন, ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর এখন এই পরিবেশে পরিবর্তন শুরু হয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির সাবেক মডারেটর মাহাদী হাসান জানান, দাড়ি ও টুপি থাকার কারণে ছাত্রলীগ তাকে ছাত্র থাকাকালীন প্রার্থী হতে দেয়নি। পরবর্তীতে ট্রান্সজেন্ডার কোটা ও কুরআন তেলাওয়াত অনুষ্ঠানে প্রশাসনের ভূমিকার সমালোচনা করায় তাকে মডারেটর পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়, ইসলামী পোশাক বা ধর্মীয় চর্চার কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর যে বৈষম্য ও নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতারই নয়, মানবাধিকারের মৌলিক লঙ্ঘন।

ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম বলেন, এই নির্মম ইতিহাস পরিবর্তনের সময় এখন। বাংলাদেশ সবার—কাউকে ‘ঊনমানুষ’ ভাবার দিন শেষ।

ডুয়া/নয়ন

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

বিশ্ববিদ্যালয় এর অন্যান্য সংবাদ