ঢাকা, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২ আশ্বিন ১৪৩২

আইএমএফের নতুন শর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন চাপ

২০২৫ সেপ্টেম্বর ২৮ ০১:০৫:৪১

আইএমএফের নতুন শর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন চাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ওপর সরাসরি সীমা নির্ধারণ করেছে, যা দেশের অর্থনীতির ওপর নতুন চাপ তৈরি করেছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৮.৪৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ নিতে পারবে। এর বাইরে ঋণ নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। এই সীমা আবার ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে— প্রথম তিন মাসে ১.৯১ বিলিয়ন ডলার এবং প্রথমার্ধে সর্বোচ্চ ৩.৩৪ বিলিয়ন ডলার। এর মাধ্যমে আইএমএফ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ঋণ ব্যবস্থাপনা খুঁটিয়ে দেখবে, যাতে বৈদেশিক ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা তৈরি না হয়।

আইএমএফ ২০২৩ সালে বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রোগ্রাম অনুমোদন করেছিল, যেখানে শুরুতে বৈদেশিক ঋণের কোনো সীমা ছিল না। তবে চলতি বছরের জুনে যখন ওই প্রোগ্রামের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একসঙ্গে ছাড়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং মূল ঋণের অঙ্ক বাড়িয়ে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার করা হয়, তখনই নতুন শর্ত হিসেবে বিদেশি ঋণের এই সীমা আরোপ করা হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি হলো আইএমএফের সর্বশেষ ডেট সাসটেইনেবিলিটি অ্যানালাইসিস (ডিএসএ), যেখানে বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি আর ‘কম ঝুঁকি’র পর্যায়ে নেই। বরং ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ দুই অর্থবছর ধারাবাহিকভাবে দেশকে ‘মধ্যম ঝুঁকি’র কাতারে রাখা হয়েছে। ঋণ পরিশোধের চাপ দ্রুত বেড়ে যাওয়া এবং ঋণ-রফতানি ও ঋণ-রাজস্বের অনুপাত অস্বাভাবিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

দেশের ইতিহাসে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বর্তমানে সর্বোচ্চ রেকর্ড স্পর্শ করেছে। গত জুন মাসেই আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বাংলাদেশ ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে। এর ফলে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১২.১৫ বিলিয়ন ডলার বা ১১ হাজার ২১৫ কোটি ডলারে। প্রতি ডলারের মূল্য ১২২ টাকা করে হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা, যা ভবিষ্যৎ ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়াচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, আইএমএফের এই পদক্ষেপ একটি বড় সতর্ক সংকেত। বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারে বাড়তি সতর্কতার আহ্বান জানিয়ে তারা বলছেন, উচ্চ সুদহার ও স্বল্প গ্রেস পিরিয়ডের মতো শর্তাবলি ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে। তাই প্রকল্প বাছাই ও বাস্তবায়নে কঠোর মূল্যায়ন এবং সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারে সতর্ক হওয়ার এবং প্রকল্পের সুষম মূল্যায়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণের অর্থ ব্যয় করে যদি রাজস্ব আদায় বা উৎপাদন নিশ্চিত করা না যায়, তবে তা অর্থনীতির ওপর চাপ ফেলবে। সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকারের আর্থিক শৃঙ্খলা দুর্বল হওয়ায় আইএমএফ এই কড়াকড়ি আরোপ করেছে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ২০.৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৮.৮ বিলিয়ন ডলারে এবং ২০২৫ সালের জুন শেষে ৮০.১৯ বিলিয়নে পৌঁছেছে। মেগা প্রকল্প ও করোনাজনিত ব্যয় এর প্রধান কারণ। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে সরকারি ও গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ তিনগুণের বেশি বেড়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নতুন ঋণ নেওয়ার প্রবণতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নতুন ঋণ নেওয়া হয়েছে ৮.৩২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টে সই হয়েছে মাত্র ২৩৪ মিলিয়ন ডলারের ঋণ, যা আইএমএফ নির্ধারিত সীমার তুলনায় নগণ্য।

তবে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে "নন-কনসেশনাল" বা অনমনীয় শর্তের ঋণ। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ইআরডির বৈঠকে একসঙ্গে ১.৪৭ বিলিয়ন ডলারের ৭টি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে। এসব ঋণের শর্ত হলো বাজারভিত্তিক সুদহার এসওএফআর (সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট)-এর ওপর লেন্ডিং স্প্রেড ও ম্যাচুরিটি প্রিমিয়াম যোগ হবে, ফলে এগুলো অনেকটাই বাজারঋণের সমান।

বাংলাদেশের রিজার্ভ এখনো স্বস্তিদায়ক নয় এবং বিনিয়োগ খাত স্থবির। এ অবস্থায় বৈদেশিক ঋণ দিয়ে বাজেট বা প্রকল্পের খরচ চালানো সাময়িক স্বস্তি দিলেও ভবিষ্যতে পরিশোধের সময় বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় কাজ হলো ঋণনির্ভরতা কমানো। রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, রফতানির বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ টানার মাধ্যমে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করানো ছাড়া বিকল্প নেই। আইএমএফের শর্ত তাই কেবল একটি সীমা নয়, বরং বাংলাদেশের জন্য বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার বার্তা।

এসপি

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

সর্বোচ্চ পঠিত