ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১ আশ্বিন ১৪৩২

বিএসইসি-ডিএসই’র নাকের ডগায় লোকসানি শেয়ার নিয়ে কারসাজি

২০২৫ সেপ্টেম্বর ২৬ ১৮:৫৬:০৮

বিএসইসি-ডিএসই’র নাকের ডগায় লোকসানি শেয়ার নিয়ে কারসাজি

বিশেষ প্রতিবেদন: সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে কারসাজির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জিকিউ বলপেন। টানা কয়েক বছর লোকসানে ডুবে থাকা এই প্রতিষ্ঠান কোনো শক্ত আর্থিক ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি। তবুও এর শেয়ারের দাম অবিশ্বাস্যভাবে বাড়ছে। বাজারদরে শেয়ারটির চিত্র দেখে মনে হয় কোম্পানিটি যেন ধারাবাহিকভাবে বিশাল মুনাফা করছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না।

সর্বশেষ ৫৭২ টাকা ৪০ পয়সায় লেনদেন হওয়া কোম্পানিটির শেয়ার এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। এর ফলে জিকিউ বলপেন ডিএসইর দর বৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে। অথচ এর প্রকৃত আর্থিক চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে লোকসানের পর লোকসান।

২০২৪ সালে কোম্পানিটি ৩ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। আগের দুই বছরেও ডিভিডেন্ডের হার ছিল ২.৫০ শতাংশের ঘরে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—টানা তিন বছর ধরে জিকিউ বলপেনের নিরীক্ষিত মুনাফা ঋণাত্মক। ২০২৪ সালে লোকসান হয়েছে শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ৫০ পয়সা, ২০২৩ সালে ১২ পয়সা আর ২০২২ সালে লোকসান ছিল ২ টাকা ৬৫ পয়সা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, জিকিউ বলপেনের শেয়ারে বিনিয়োগের যুক্তি খাড়া করার কোনো সুযোগ নেই। কোম্পানিটির পিই রেশিও নেতিবাচক, আর্থিক ভিত্তি দুর্বল, অথচ শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে আকাশচুম্বী। পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। অল্প মূলধনের কারণেই কারসাজিকারীরা কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে ইচ্ছেমতো আকাশে তুলছে।

অথচ একই খাতের আরেকটি শক্তিশালী ও মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) একেবারেই ভিন্ন চিত্রে অবস্থান করছে। ২০২৪ সালে কোম্পানিটি দিয়েছে ২৫ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড, আর চলতি ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে তাদের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৪ টাকা ২৮ পয়সা—যা ধারাবাহিকভাবে উন্নতির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তবুও বিস্ময়ের বিষয় হলো, বিএসসির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে এখনো ১২০ টাকার নিচে। বিপরীতে টানা লোকসানে থাকা জিকিউ বলপেনের শেয়ার লাফিয়ে উঠে পৌঁছেছে ৫৭২ টাকায়। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগে, ২০২৫ সালের ২৩ জুন, এই শেয়ারের দাম ছিল ১৬০ টাকার নিচে। প্রশ্ন উঠছে—যেখানে শক্ত মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি অবমূল্যায়িত, সেখানে লোকসানি জিকিউ বলপেনের শেয়ার এমন অস্বাভাবিক দামে কেন এবং কিভাবে লেনদেন হচ্ছে?

বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করছেন, এটি মূলত কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি ও দর বাড়ানোর এক প্রকার খেলা, যা ঘটছে বিএসইসি ও ডিএসই’র নাকের ডগায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো—নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কার্যত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। যখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পথে বসে যান এবং কারসাজিকারীরা মোটা অঙ্কের মুনাফা নিয়ে বাজার থেকে সটকে পড়ে, তখনই কেবল তাদের ধরার উদ্যোগ নেয়া হয়। অথচ শাস্তি হিসেবে তাদের দিতে হয় সামান্য জরিমানা, যা তাদের করা অবৈধ মুনাফার তুলনায় একেবারেই নগণ্য। ফলে কার্যত এই ব্যবস্থাও কারসাজিকারীদের জন্য এক ধরনের নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএসইসি ও ডিএসইর বিপরীত অবস্থানগত কারণেই কারসাজিকারীদের সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে। বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে শুধু নামমাত্র জরিমানা নয়, বরং কঠোর শাস্তি ও বাস্তবায়নযোগ্য শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ভেঙে পড়বে, আর দীর্ঘমেয়াদে শেয়ারবাজার রূপ নেবে একদল প্রভাবশালী কারসাজিকারীর খেলার মাঠে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কেবল সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই।

এএসএম/

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

সর্বোচ্চ পঠিত