ঢাকা, শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১ ভাদ্র ১৪৩২

এস আলম থেকে বেক্সিমকো: ব্যাংক খাতে ১৫ বছরের লুটপাট

আবু তাহের নয়ন
আবু তাহের নয়ন

সিনিয়র রিপোর্টার

২০২৫ সেপ্টেম্বর ০৫ ১৮:৫০:৪৬

এস আলম থেকে বেক্সিমকো: ব্যাংক খাতে ১৫ বছরের লুটপাট

আবু তাহের নয়ন: বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গত ১৫ বছরে নজিরবিহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের শিকার হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যাংকারদের নেতৃত্বে অন্তত ১১টি ব্যাংক দখল করে বিপুল ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যার বড় অংশ বর্তমানে খেলাপি।

এই সময় জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, এন্যান টেক্স, ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ, এস আলম, বেক্সিমকো, সিকদার, ওরিয়ন, নাসা ও নাবিল। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের জালিয়াতি ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা, যার ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। খেলাপি ঋণ বর্তমানে ৪০ হাজার কোটি টাকা।

বেক্সিমকো গ্রুপের খেলাপি ঋণ ২০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা, সিকদার গ্রুপের ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের এই অবস্থা সাধারণ গ্রাহকদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ভয়াবহ তারল্য সংকটে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণ ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা খেলাপি। মূলধনে ঘাটতি ৪৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা।

২০২০ থেকে ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে। ২০২০ সালে তা ছিল ৯৬ হাজার ১২০ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি, ২০২৪ সালে ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি, আর চলতি বছরের মার্চে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে ১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা।

ব্যাংক খাতের অস্থিরতায় গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ কষ্টার্জিত অর্থ ফেরত না পেয়ে হতাশ। অনেকে ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছেন, আবার কেউ ব্যাংকে গিয়ে কান্নাকাটি করে ফিরে আসছেন।

গত বছরের ৫ আগস্ট নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হয়েছে, ৫২ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে এবং একীভূতকরণের মাধ্যমে খাত স্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, যেসব ব্যাংক আর্থিক সূচকে উন্নতি করতে ব্যর্থ হবে, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত করা হবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংকটের মূল কারণ দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ধারাবাহিক লুটপাট এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ। সাবেক গভর্নর ও বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে’। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, খাত পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন ৩৫ বিলিয়ন ডলার।

বর্তমানে অন্তবর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ, দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ এবং কঠোর তদারকির মাধ্যমে ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। তবে গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে আরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ অপরিহার্য।

এএসএম/

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

সর্বোচ্চ পঠিত