ঢাকা, সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭ ভাদ্র ১৪৩২

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: নিরাপত্তা কৌশল ও চ্যালেঞ্জ

২০২৫ সেপ্টেম্বর ০১ ২০:৫০:৫৪

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: নিরাপত্তা কৌশল ও চ্যালেঞ্জ

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নতুন নতুন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বিশেষত, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ কিছু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: পূর্ববর্তী বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়া, দেশের সব ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা, রাজনৈতিক পক্ষপাত ছাড়াই সব সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো, নির্বাচনের আগে বেহাত হওয়া সব অস্ত্র উদ্ধার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির এক বৈঠকে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন এবং স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক সহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।

নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে নিশ্চিত করতে ৩১ ডিসেম্বরকে একটি সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সদস্য নিয়োগ ও পাসিং আউট কার্যক্রমও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নির্বাচনের আগে বেহাত হওয়া অস্ত্র উদ্ধার সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, পূর্বে একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও তা সফল হয়নি। এখনো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে রয়ে গেছে, যা উদ্ধার না হলে সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও সহিংসতা ঠেকানো কঠিন হতে পারে।

নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে সরকার গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উদ্যোগও নিচ্ছে। দেশের সব ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের তালিকা করে সেগুলোকে বিশেষ নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে, যেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকেও এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে এবং একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেন্টার স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।

এছাড়া, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কোনো ব্যক্তিকে আসন্ন নির্বাচনে দায়িত্ব দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও পুলিশ অধিদপ্তরকে কাজ করতে বলা হয়েছে।

আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে অবনতি না ঘটে সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ডিজিএফআই, এনএসআই এবং পুলিশের বিশেষ শাখাকে নজরদারি বাড়ানো এবং সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়ে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, আনসার ও ভিডিপি এবং বিজিবিকেও সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচনের আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। অপপ্রচার রোধে 'কাউন্টার ন্যারেটিভ' প্রস্তুত করে প্রকৃত ঘটনা দেশবাসীকে জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুটি পৃথক প্রস্তুতিমূলক মহড়া পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই মহড়ার মাধ্যমে সম্ভাব্য ঝুঁকি পর্যালোচনা, ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় পরিকল্পনা এবং জরুরি যোগাযোগ কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে বেহাত হওয়া অস্ত্র উদ্ধার। গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত বেহাত রয়েছে এক হাজার ৩৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং দুই লাখ ৫৭ হাজার ৭২০ রাউন্ড গুলি। সরকার এসব অস্ত্র উদ্ধারে তথ্যদাতাদের জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করেছে।

এছাড়াও, নির্বাচনের আগে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতিকারীদের কর্মকাণ্ড রোধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দল, মত, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সরকার মুহাম্মদ শামসুদ্দিন উভয়েই সরকারের এই উদ্যোগকে ইতিবাচক বলেছেন। তবে, তারা জোর দিয়ে বলেন যে, মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং অপপ্রচার ও সমালোচনার স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই আসল চ্যালেঞ্জ হবে।

এসপি

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

সর্বোচ্চ পঠিত