ঢাকা, শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

গার্বেজ কোম্পানিতেই আইসিবি’র এক-পঞ্চমাংশ বিনিয়োগ

২০২৫ নভেম্বর ২৮ ২১:০২:২১

গার্বেজ কোম্পানিতেই আইসিবি’র এক-পঞ্চমাংশ বিনিয়োগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাষ্ট্রায়ত্ত ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) বর্তমানে চরম আর্থিক সংকটে থাকা একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথম শ্রেণির এক জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ জানিয়েছেন—প্রতিষ্ঠানটির মোট বিনিয়োগের ২০ শতাংশই এখন ‘গার্বেজ’ বা কাগুজে শেয়ারে পরিণত হয়েছে।

গত দশ বছরে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং অদক্ষ পরিচালনার কারণে দীর্ঘদিনের লাভজনক প্রতিষ্ঠান আইসিবি এখন বড় ধরনের লোকসানি প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।

দুর্নীতি শনাক্তে উদ্যোগহীনতা

অধ্যাপক আবু আহমেদ জানান, ব্যক্তিস্বার্থে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করায় প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের মুখে পড়েছে। বিএসইসির নির্দেশে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া হয়েছিল ‘বাজার সমর্থন’ দেওয়ার নামে, কিন্তু সেই সিদ্ধান্তই বর্তমানে আইসিবির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, দায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি—অনেকে চাকরি ছেড়ে বিদেশে চলে গেছেন, আর কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে। তাঁর মতে, সরকার চাইলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে।

সরকারি ঋণে টিকে থাকার চেষ্টা

প্রতিষ্ঠানটির সঙ্কট মোকাবিলায় সরকার এ সপ্তাহে ১,০০০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিয়েছে। এর আগে এপ্রিল মাসে আরও ৩,০০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মোট ৪,০০০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা পেয়েছে আইসিবি।

ঋণগুলো ৫ শতাংশ সুদে ১০ বছরে পরিশোধ করতে হবে; এর মধ্যে এক বছর গ্রেস পিরিয়ড। আগের ৩,000 কোটির মধ্যে ২,000 কোটি টাকা ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে, আর ১,000 কোটি টাকা বাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। নতুন পাওয়া ১,000 কোটি টাকা ভালো ডিভিডেন্ড প্রদানকারী ‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানিতে বিনিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে

ঋণের বোঝা ও ভুল বিনিয়োগ

আইসিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ঋণের পরিমাণ ১০,৫০০ কোটি টাকার বেশি। পূর্ববর্তী বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক খায়রুল হোসেন ও অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের চাপের মুখে আইসিবিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়েছিল বাজার রক্ষার নামে।

দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আইসিবির কিছু কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে খায়রুল হোসেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন এবং শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম কারাগারে আছেন।

এসব কারণে আইসিবির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ বিনিয়োগ এখন কার্যত মূল্যহীন, যার বাজারদর ক্রয়মূল্যের তুলনায় বহু গুণ কমে গেছে। অনেক শেয়ার বিক্রি করার মতো ক্রেতাও নেই। বাজারের সামগ্রিক মন্দা পরিস্থিতি এই সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, কারণ ভালো কোম্পানির শেয়ারও ৩০–৫০% পর্যন্ত কমে গেছে।

প্রভিশনিং ঘাটতি ও বিরাট লোকসান

২০২৫ সালের ৩০ জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়—আইসিবির প্রভিশনিং ঘাটতি ৩,৪৫৯ কোটি টাকারও বেশি, যেখানে আগের বছরে তা ছিল ৩,১৭৯ কোটি টাকা।

বিএসইসি প্রভিশনিং পূরণে সময় বাড়ালেও আইসিবি তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়নি। ২০২৪ সালের মে মাসে বিএসইসি ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ায়, তবে সংশ্লিষ্টরা জানান—এই সময়ের মধ্যেও প্রভিশনিং করা সম্ভব নয়।

২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ১,২১৪ কোটি টাকার রেকর্ড লোকসান করেছে। বর্তমান ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও লোকসান ১৫১ কোটি টাকা।

উচ্চ সুদে নেওয়া বিভিন্ন ব্যাংকঋণের বিপরীতে প্রতি মাসে ৯০ কোটি টাকা সুদ দিতে হচ্ছে—যা আইসিবির মোট আয়ের ৯৪ শতাংশ।

লাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে লোকসানে পতন

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯–১০ থেকে ২০১৭–১৮ অর্থবছর পর্যন্ত আইসিবি গড়ে ৪০০ কোটি টাকার মতো নিট মুনাফা করত।

২০১৭–১৮ অর্থবছরে মুনাফা ছিল ৪১৬ কোটি টাকা, কিন্তু পরের বছর তা ৮৫ শতাংশ কমে ৬০ কোটি টাকায় নেমে আসে।

পরবর্তী ছয় বছরে (২০১৮–২০২৪) গড়ে মুনাফা দাঁড়ায় মাত্র ৮১ কোটি টাকা। সবশেষ ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ১,২১৫ কোটি টাকা নিট লোকসান করে।

এএসএম/

শেয়ারবাজারের বিশ্লেষণ ও ইনসাইড স্টোরি পেতে আমাদের পেজ ফলো করুন।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত