ঢাকা, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২

ফ্যাশনের রাজ্যে বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনী

ইনজামামুল হক পার্থ
ইনজামামুল হক পার্থ

রিপোর্টার

২০২৫ অক্টোবর ১৩ ১৪:৪২:৫৫

ফ্যাশনের রাজ্যে বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনী

ইনজামামুল হক পার্থ: বিশ্বজুড়ে ধনকুবেরদের সম্পদ যেখানে প্রযুক্তি, জ্বালানি বা আর্থিক খাতে কেন্দ্রীভূত, সেখানে ফ্যাশন ও খুচরা বিক্রয় শিল্পও তৈরি করেছে বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য। এই খাত শুধু পোশাক বা সৌন্দর্যসামগ্রী বিক্রয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় এটি এখন বিশ্ব অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। ফোর্বসের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ বলছে, ফ্যাশন ও খুচরা ব্যবসার মাধ্যমে গড়ে ওঠা ব্র্যান্ড সাম্রাজ্য থেকে উঠে এসেছেন বিশ্বের অনেক শীর্ষ ধনী ব্যক্তি। তাঁদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি উত্তরাধিকার, ব্র্যান্ড সম্প্রসারণ, অধিগ্রহণ এবং বৈশ্বিক প্রভাব।

১. বার্নার্ড আর্নল্ট: ফ্যাশন জগতের শীর্ষ ধনী এবং বৈশ্বিক তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছেন ফ্রান্সের বার্নার্ড আর্নল্ট। তাঁর নেতৃত্বাধীন এলভিএমএইচ (LVMH) এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিলাসপণ্য সাম্রাজ্য। লুই ভিটন, ক্রিশ্চিয়ান ডিওর, সেফোরা এই নামগুলোই তাঁর ব্র্যান্ড শক্তির প্রতীক। ২০২১ সালে ১৫.৮ বিলিয়ন ডলারে টিফানি অ্যান্ড কোম্পানি কিনে তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিলাসবহুল ব্র্যান্ড অধিগ্রহণ সম্পন্ন করেন। আর্নল্টের পারিবারিক বিনিয়োগ কোম্পানি আগাশ ও আগলা ভেঞ্চার্স নেটফ্লিক্স ও বাইটড্যান্সের মতো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। নির্মাণ ব্যবসা থেকে উঠে এসে ১৯৮৪ সালে মাত্র ১৫ মিলিয়ন ডলারে ক্রিশ্চিয়ান ডিওর কেনা থেকেই তাঁর এই সাম্রাজ্যের সূচনা। বর্তমানে তাঁর পাঁচ সন্তানই এলভিএমএইচ–এর গুরুত্বপূর্ণ পদে যুক্ত।

২. আমানসিও ওর্তেগা: স্পেনের আমানসিও ওর্তেগা বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী ফ্যাশন উদ্যোক্তা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিটেক্স গ্রুপের অধীনে জারা, পুল অ্যান্ড বেয়ার, ম্যাসিমো দুত্তি, ও বর্শকা সহ আটটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ৫ হাজারেরও বেশি দোকান পরিচালনা করছে এই গ্রুপ। ২০২২ সালে তাঁর মেয়ে মার্তা ওর্তেগা পেরেস কোম্পানির চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব নেন।

ওর্তেগা প্রতিবছর ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ করেন। খুচরা বিক্রয়ে দ্রুত সরবরাহ এবং ট্রেন্ড নির্ভর উৎপাদনের মাধ্যমে তিনি “ফাস্ট ফ্যাশন” ধারণাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তুলেছেন।

৩-৬. ওয়ালটন পরিবার: ওয়ালমার্টের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ওয়ালটনের উত্তরাধিকারীরা এখনো বিশ্বের ধনীদের তালিকায় আধিপত্য বিস্তার করছেন। রব ওয়ালটন, জিম ওয়ালটন, অ্যালিস ওয়ালটন এবং লুকাস ওয়ালটন এই চারজনই ফোর্বসের শীর্ষ দশ ফ্যাশন ও খুচরা খাতের ধনীদের মধ্যে আছেন।

রব ওয়ালটন ১৯৯২ সালে বাবার মৃত্যুর পর ওয়ালমার্টের চেয়ারম্যান হন। তাঁর নেতৃত্বে ওয়ালমার্ট হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা। ২০২২ সালে তিনি ৪৭০ কোটি ডলারে এনএফএল দল ডেনভার ব্রঙ্কোস কেনেন।

জিম ওয়ালটন আরভেস্ট ব্যাংক গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং ওয়ালটন ফ্যামিলি ফাউন্ডেশনের অন্যতম দায়িত্বশীল সদস্য। তাঁর কন্যা অ্যানি প্রোয়েতি এখন এই দাতব্য ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান।

অ্যালিস ওয়ালটন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী নারী। তিনি লরিয়ালের উত্তরাধিকারী ফ্রাঁসোয়াজ মেয়ার্সকে টপকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী হিসেবে ফোর্বসের তালিকায় উঠে এসেছেন। তাঁর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১১০ বিলিয়ন ডলার।

লুকাস ওয়ালটন, ওয়ালমার্ট প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ওয়ালটনের নাতি, এখন পরিবারের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি। তিনি “বিল্ডার্স ভিশন” নামে একটি দাতব্য বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে কাজ করছে।

৭. ফ্রাঁসোয়া বেতনক্যুঁ মেয়ার্স: ল’রিয়ালের প্রতিষ্ঠাতার নাতনি ফ্রাঁসোয়া মেয়ার্স এবং তাঁর পরিবার এখনো কোম্পানির এক–তৃতীয়াংশ শেয়ারের মালিক। তিনি বিশ্বের অন্যতম ধনী নারী, যার সম্পদের পরিমাণ ৮১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তাঁর পরিবার শুধু ব্যবসাতেই নয়, সামাজিক দায়িত্বেও অগ্রগামী ২০১৯ সালে নটরডেম ক্যাথেড্রাল সংস্কারে ২২৬ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয় ল’রিয়াল ও বেটেনকোর্ট পরিবার।

৮. তাদাশি ইয়ানাই: জাপানের পোশাক ব্র্যান্ড ইউনিক্লোর প্রতিষ্ঠাতা তাদাশি ইয়ানাই ফাস্ট রিটেইলিং কোম্পানির কর্ণধার। তাঁর নেতৃত্বে ইউনিক্লো এখন বিশ্বের ২৫টি দেশে ২,৫০০–এর বেশি দোকান পরিচালনা করছে। ২০২৪ অর্থবছরে কোম্পানির আয় দাঁড়ায় ২১ বিলিয়ন ডলার। ইয়ানাইয়ের লক্ষ্য ইউনিক্লোকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোশাক বিক্রেতা বানানো, জারার ইন্ডিটেক্সকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।

৯. ডিটার শ্বর্জ: জার্মান উদ্যোক্তা ডিটার শ্বর্জের শ্বর্জ গ্রুপ পরিচালনা করে কফল্যান্ড ও লিডল নামের সুপারমার্কেট চেইন। ১৬০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক আয় নিয়ে তিনি ইউরোপের সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা। তাঁর প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ইউরোপজুড়ে প্রায় ৫ লাখ কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।

১০. জেরার্ড ভের্টহাইমার: চ্যানেল ব্র্যান্ডের মালিকানা এখন ভের্টহাইমার পরিবারের হাতে। জেরার্ড ও তাঁর ভাই অ্যালেন যৌথভাবে কোম্পানির দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের দাদু পিয়েরে ভের্টহাইমার কো কো চ্যানেলের সঙ্গে মিলে এই বিলাসবহুল ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কার্ল লাগারফেল্ডের সৃজনশীল নেতৃত্বে চ্যানেল তিন দশকের বেশি সময় বিশ্ব ফ্যাশনের প্রতীক হিসেবে জায়গা ধরে রেখেছে।

এই তালিকা স্পষ্ট করে যে ফ্যাশন ও খুচরা বিক্রয় শিল্প এখন কেবল নান্দনিকতার প্রতীক নয় এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির শক্তিশালী স্তম্ভ। উত্তরাধিকার, ব্র্যান্ড বৈচিত্র্য, আধুনিক বিপণন কৌশল ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমে এই উদ্যোক্তারা শুধু সম্পদশালী নন, বরং অর্থনৈতিক প্রভাবের দিক থেকেও শীর্ষে।

ওয়ালটন পরিবার একা ১০ জনের মধ্যে ৪টি স্থান দখল করে প্রমাণ করেছে পারিবারিক উত্তরাধিকার কীভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অন্যদিকে বার্নার্ড আর্নল্ট বা তাদাশি ইয়ানাইয়ের মতো উদ্যোক্তারা প্রমাণ করেছেন, ফ্যাশনের সৃজনশীলতাও তৈরি করতে পারে বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য।

বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে ফ্যাশন ও খুচরা বিক্রয় খাত আজ শুধু বাণিজ্য নয়, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের অংশ হয়ে উঠেছে। এসব ব্র্যান্ড শুধু পণ্য বিক্রি করে নাতারা জীবনধারার প্রতীক, রুচির পরিচায়ক এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির চালিকা শক্তি। বার্নার্ড আর্নল্ট, আমানসিও ওর্তেগা কিংবা ওয়ালটন পরিবারের মতো উদ্যোক্তারা দেখিয়ে দিয়েছেন, সৃজনশীলতা, ব্র্যান্ড কৌশল এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের সমন্বয়ে গড়ে তোলা যায় এমন এক সাম্রাজ্য, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রভাব বিস্তার করে। ফ্যাশনের এই দুনিয়া তাই শুধু বিলাস নয়, এক অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক।

ইএইচপি

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত