ঢাকা, শনিবার, ৯ আগস্ট ২০২৫, ২৫ শ্রাবণ ১৪৩২

নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের মাস্টারপ্ল্যান ফাঁস

ডুয়া নিউজ- জাতীয়
২০২৫ আগস্ট ০৮ ১২:৫৭:৫০
নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের মাস্টারপ্ল্যান ফাঁস

গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও লুটপাটের নানা তথ্য জাতির সামনে উঠে আসে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা জনরোষ এড়াতে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর থেকেই শেখ পরিবারসহ আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মীরা গোপনে দেশত্যাগ করেন।

বর্তমানে দলটি বিদেশ থেকেই দেশে নির্বাচন প্রতিহতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কার্যত নিষ্ক্রিয় এবং নিষিদ্ধ এই দলটির নেতারা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় হলেও তাঁদের বক্তব্যে অনুশোচনার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম ও নিবন্ধন স্থগিত করেছে এবং তাদের দীর্ঘদিনের প্রতীক ‘নৌকা’ বাতিল করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ দাবি করছে, সরকার ও অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের এবং তাদের মিত্রদের বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করতে চাইছে। সেই কারণেই দলটি আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যেসব নেতার অপকর্মের দায়ে আওয়ামী লীগ এই অবস্থায় পড়েছে তারা এখনো বিদেশে বসে দল পরিচালনার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষমতা হারানোর পর এক বছর পার হলেও তাদের মধ্যে অনুশোচনার লেশমাত্র নেই। বরং তারা নিয়মিত নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইছেন এবং দলীয় কর্মীদের বিভ্রান্ত করছেন।

বিদেশে বসে এই নেতারা এখন মূলত ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টায় লিপ্ত। পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থানের নেতৃস্থানীয় শক্তির ভেতর বিভাজন তৈরির চেষ্টাও করছে তারা। দেশের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গোপনে বিভিন্ন তৎপরতা চালানো হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতোমধ্যে এসব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে এবং সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ী দুর্নীতিপরায়ণ নেতারাই এখনো দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন। দেশের সাধারণ মানুষ এবং দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের চিন্তা-ভাবনা বিবেচনায় না নিয়ে তারা বিদেশে স্বজনদের নিয়ে নিরাপদ জীবন কাটাচ্ছেন এবং ভেতরে থাকা কর্মীদের বিপদে ফেলে মাঠে নামতে উসকে দিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম গণমাধ্যমকে বলেন, এতবড় একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের পতন হলো, তারপরেও দলটির কোনো নেতাকর্মীর আত্মোপলব্ধি নেই, বোধোদয় নেই। বরং নিজেদের ভুলগুলোর পক্ষেই সাফাই গেয়ে যাচ্ছে।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিপরীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশটাকে সম্পূর্ণভাবে স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে নিয়ে গিয়েছিল। দলটির নেতারা সীমাহীন দুর্নীতি-লুটপাট-অর্থ পাচার, গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি ভিন্নমত দমনের পোড়ানীতি গ্রহণ করে। যার খেসারত দিতে হয়েছে তাদের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের একজন নেতাও এখন পর্যন্ত নিজেদের ভুল স্বীকার করেননি। বরং দেশের পরিস্থিতি অশান্ত করতে বিদেশের মাটিতে বসে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন।

বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের একজন পলাতক নেতা বলেন, ক্ষমতার সাড়ে ১৫ বছর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, মাহবুবউল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাসিম, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমসহ একটি প্রভাবশালী চক্রের হাতে আওয়ামী লীগ জিম্মি ছিল।

ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করার বদলে সর্বত্র স্বজনপ্রীতির রাজনীতি করেছেন তারা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দিনের পর দিন চেষ্টা করেও সাধারণ নেতাকর্মীরা ক্ষমতাধর এই নেতার দেখা পেতেন না।

লন্ডন প্রবাসী ওই নেতা বলেন, ৫ আগস্টের ঘটনায় শিক্ষা নিয়ে আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজানোটা যখন অপরিহার্য, ঠিক তখন সেই ওবায়দুল কাদেরসহ পুরোনো সিন্ডিকেট ফের সরব এবং সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, যারা আওয়ামী লীগকে ডুবিয়েছে, তারাই বিদেশে বসে এখন আওয়ামী লীগের হাল ধরতে চাইছে। এরা হাল ধরলে আওয়ামী লীগের যে অস্তিত্বটুকু এখন পর্যন্ত আছে, তাও আর থাকবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে কলকাতায় পালিয়ে থাকা ওবায়দুল কাদের দীর্ঘদিন চুপচাপ থাকার পর ফের সরব হয়েছেন। নিজের অবস্থান সংহত করার জন্য পলাতক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

সম্প্রতি কলকাতার মারকুইস স্ট্রিটে ‘বাংলা খাবার’ নামের একটি রেস্টুরেন্টে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন ওবায়দুল কাদের। আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাসিম, মির্জা আজম, যুবলীগ নেতা নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ইসমাইল হোসেন সম্রাট, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা অপতৎপরতা নিয়ে আলোচনা করেন তারা।

পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমে বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি বাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, কিছু লোক সামাজিক মাধ্যমে এসে অপপ্রচার চালাচ্ছে-তাদের ওপর কঠোর নজরদারি রয়েছে।

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে মেজর সাদিকুল ও তার স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় সুমাইয়াকে ৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। আর মেজর সাদিকুল হক সেনা হেফাজতে রয়েছেন।

এর আগে ১৩ জুলাই রাজধানীর ভাটারা থানায় একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলার এজাহারে বলা হয় ৮ জুলাই শহরের একটি কনভেনশন সেন্টারে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা ওই বৈঠকে অংশ নেয় প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ জন যাদের মধ্যে ছিলেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সদস্য, কার্যক্রম স্থগিত হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা।

বৈঠকে তারা সরকারবিরোধী স্লোগান দেন এবং একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ পেলে দেশজুড়ে লোকজন রাজধানীতে এসে সমবেত হবেন। এরপর শাহবাগ মোড় দখলের মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি ও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে শেখ হাসিনার পুনরায় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করার ষড়যন্ত্র করা হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

তথ্য: যুগান্তর

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত