ঢাকা, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২

গর্ভে থাকতেই শিশু বুকিং, ভয়ঙ্কর পাচার চক্রের পর্দাফাঁস

ডুয়া নিউজ- আন্তর্জাতিক
২০২৫ জুলাই ২০ ১০:২৬:৩৯
গর্ভে থাকতেই শিশু বুকিং, ভয়ঙ্কর পাচার চক্রের পর্দাফাঁস

ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ এক ভয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক শিশু পাচার চক্রের পর্দাফাঁস করেছে, যারা গর্ভবতী নারীদের নিশানা করে তাদের অনাগত সন্তানকে 'বুকিং' করে নিত এবং জন্মের পর সিঙ্গাপুরে বিক্রি করে দিত। ২০২৩ সাল থেকে সক্রিয় এই চক্রটি এখন পর্যন্ত অন্তত ২৫টি শিশুকে বিক্রি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

চলতি সপ্তাহে পন্তিয়ানাক এবং তাংরাং শহর থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত ১৩ জনকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি ছয়টি শিশুকে পাচারের ঠিক আগে উদ্ধার করেছে পুলিশ। উদ্ধার হওয়া প্রতিটি শিশুর বয়স এক বছরেরও কম।

যেভাবে চলত এই নৃশংস কারবার

পশ্চিম জাভা পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল অব ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন, সুরাওয়ান জানিয়েছেন, চক্রটি মূলত আর্থিক অনটন, সামাজিক চাপ বা অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের কারণে সন্তান পালনে অনিচ্ছুক গর্ভবতী নারী ও পরিবারকে নিশানা করত।

টার্গেট নির্ধারণ: ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথমে অসহায় নারীদের খুঁজে বের করা হতো। পরে হোয়াটসঅ্যাপের মতো ব্যক্তিগত অ্যাপের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হতো।

গর্ভেই 'বুকিং': কিছু ক্ষেত্রে শিশুরা মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই তাদের জন্য ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম নিয়ে নেওয়া হতো।

প্রলোভন ও চুক্তি: পাচারকারীরা সন্তানের প্রসব সংক্রান্ত সমস্ত খরচ বহন করত এবং পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু টাকা দিয়ে শিশুটিকে নিয়ে যেত। অনেক সময় অপহরণের অভিযোগ এড়াতে বাবা-মায়ের সঙ্গে একটি চুক্তিও করা হতো।

জাল নথি তৈরি: মায়ের কাছ থেকে শিশুকে আলাদা করার পর দুই-তিন মাস একজন তত্ত্বাবধায়কের কাছে রাখা হতো। এই সময়ের মধ্যে জাকার্তা ও পন্তিয়ানাকে শিশুটির জন্ম সনদ, পাসপোর্টসহ অন্যান্য পরিচয়পত্র জাল করা হতো।

বিক্রি: সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেলে প্রতিটি শিশুকে ১১ মিলিয়ন (প্রায় ৬৭৩ ডলার) থেকে ১৬ মিলিয়ন ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়াহর বিনিময়ে সিঙ্গাপুরে থাকা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হতো।

তদন্ত ও আন্তর্জাতিক সহায়তা

গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা স্বীকার করেছে যে তারা এ পর্যন্ত ১২ জন ছেলে ও ১৩ জন মেয়েকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিক্রি করেছে। পুলিশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সিঙ্গাপুরে থাকা ওই শিশুদের এবং তাদের ক্রেতাদের খুঁজে বের করা।

সুরাওয়ান বলেন, "আমাদের কাছে তথ্য আছে যে পাচার হওয়া শিশুদের নাগরিকত্ব পরিবর্তন করা হয়েছে।" এই পরিস্থিতিতে অপরাধীদের ধরতে ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ ইন্টারপোল এবং সিঙ্গাপুর পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েছে। অভিযুক্তদের 'ওয়ান্টেড' অপরাধী হিসেবে ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া চলছে।

নেপথ্যের সামাজিক সংকট

ইন্দোনেশিয়ার শিশু সুরক্ষা কমিশন (KPAI) জানিয়েছে, এই ধরনের পাচার চক্রগুলো প্রায়ই সমাজের দুর্বল নারীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়। যৌন সহিংসতার শিকার, স্বামীর দ্বারা পরিত্যক্তা বা অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের কারণে সমস্যায় জর্জরিত নারীরাই তাদের প্রধান লক্ষ্য।

কমিশনের মতে, ইন্দোনেশিয়ায় গর্ভপাত আইনত নিষিদ্ধ (ব্যতিক্রম ছাড়া) হওয়ায় এবং সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে অনেক নারী এই অপরাধীদের পাতা ফাঁদে পা দেন। পাচারকারীরা প্রায়ই নিজেদের মাতৃসদন বা সমাজসেবী সংস্থার কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করে।

পরিসংখ্যান বলছে, ইন্দোনেশিয়ায় এই ধরনের অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। ২০২০ সালে যেখানে শিশুদের অবৈধ দত্তক নেওয়ার ১১টি ঘটনা হয়েছিল, ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯-এ। এই ঘটনা আরও একবার শিশু পাচারের মতো গুরুতর অপরাধের পেছনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোকে সামনে নিয়ে এল।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত