ঢাকা, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপে ৮ বহুজাতিক কোম্পানি

ডুয়া নিউজ- শেয়ারবাজার
২০২৫ জুন ৩০ ১২:১৭:০৩
বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপে ৮ বহুজাতিক কোম্পানি

দেশের শেয়ারবাজারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরিচালনা, স্থিতিশীল আয় এবং নিয়মিত ডিভিডেন্ড প্রদানের কারণে এই কোম্পানিগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের শীর্ষে ছিল।

তবে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেই দৃঢ় আস্থায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশিরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ১১টি বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে ৮টির শেয়ার চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বিদেশিরা আংশিকভাবে বিক্রি করেছেন। এই বিক্রি করা শেয়ারগুলোর সম্মিলিত বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

যেসব বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিক্রি করেছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: রেকিট বেনকিজার, ম্যারিকো বাংলাদেশ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটিবিসি), বাটা সু, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, আরএকে সিরামিকস, সিঙ্গার বাংলাদেশ এবং গ্রামীণফোন।

অন্যদিকে, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ, ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার এবং হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারণে চলতি বছরে কোনো বড় পরিবর্তন আসেনি।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো ডলারের বিপরীতে টাকার ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন। টাকার মান কমে যাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্থানীয় মুদ্রায় অর্জিত মুনাফা ডলারের হিসাবে হ্রাস পাচ্ছে, যা তাদের বিনিয়োগ থেকে প্রত্যাশিত লাভকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

এছাড়াও, শেয়ারবাজারে ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছে। ডিএসই'র পরিচালক রিচার্ড ডি' রোজারিও এ বিষয়ে বলেন, যখন ফ্লোর প্রাইস কার্যকর হয়, তখন বাজার থেকে এক্সিটের পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশিরা এই ব্যবস্থাকে 'নন-কমপ্লায়েন্ট মার্কেট' বা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বাজার হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর ফললে তারা সুযোগ পেলেই শেয়ার বিক্রি করে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করছে।

যেসব বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার বেশি বিক্রি হয়েছে, সেগুলোর প্রাসঙ্গিক তথ্য নিচে দেওয়া হলো-

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটিবিসি)

গত ৫ মাসে বিএটিবিসির প্রায় ১৭ লাখ ৮২ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছে। যার বাজারমূল্য ৫০ কোটি ৮২ লাখটাকা। বিএটিবিসি ২০২৪ সালে ৩০০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছিল।

রেকিট বেনকিজার

আলোচ্য সময়ে প্রায় ৪৮ হাজার ৬৬৮টি শেয়ার বিক্রি করেছে। যার বাজারমূল্য ১৬.২৭ কোটি টাকা। এই কোম্পানিটি ২০২৪ সালে ৩৩৩০ শতাংশ রেকর্ড পরিমাণ ক্যাশ ডিভিডেন্ড প্রদান করেছিল।

ম্যারিকো বাংলাদেশ

কোম্পানিটির ৩৭ হাজার ৮০০টি শেয়ার বিক্রি করেছে। যার বাজারমূল্য ৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ম্যারিকোও ২০২৪ সালে ৩৮৪০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড প্রদান করেছে।

সিঙ্গার বাংলাদেশ: ১৩.৬৫ লাখ শেয়ার বিক্রি হয়েছে, যার বাজারমূল্য ১৫.০৬ কোটি টাকা। কোম্পানিটি ২০২৪ সালে ১০% নগদ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল।

গ্রামীণফোন

কোম্পানিট ২ লাখ ৭০ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছে। যার বাজারমূল্য ৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। গ্রামীণফোন ২০২৪ সালে ৩৩০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু উচ্চ ডিভিডেন্ড নয়, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টাকার অবমূল্যায়ন হলে মুনাফা থেকেও লোকসান হয়। গত কয়েক বছরে ডলারের অস্থিরতার কারণে অনেকেই বাজার থেকে ফান্ড তুলে নিয়েছেন। কারণ তাদের অর্জিত মুনাফা ডলারের হিসাবে কম হয়ে যাচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।

বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদিও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মৌলিক ভিত্তি এখনো মজবুত, তবুও বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ওপর বিদেশিদের আস্থা নষ্ট হয়েছে মূলত নীতিগত অনিশ্চয়তা এবং সামগ্রিক আর্থিক পরিবেশের ঝুঁকির কারণে। দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে টাকার মান স্থিতিশীল রাখা, নিয়ন্ত্রক নীতিমালায় স্বচ্ছতা আনা এবং শেয়ারবাজারের সামগ্রিক পরিবেশকে আরও বিনিয়োগবান্ধব করে তোলা অত্যন্ত জরুরি।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত