ঢাকা, সোমবার, ১৮ আগস্ট ২০২৫, ৩ ভাদ্র ১৪৩২

রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর নেপথ্যের বার্তা

ডুয়া নিউজ- জাতীয়
২০২৫ আগস্ট ১৮ ১১:০৩:২৫
রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর নেপথ্যের বার্তা

চলতি মাসে অন্তর্বর্তী সরকার এক বছর পূর্ণ করেছে। এ সময় জুড়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদে থাকা না-থাকা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যেই হঠাৎ করে বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলো থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। উল্লেখ্য যে এ নির্দেশনা এসেছে টেলিফোনের মাধ্যমে।

বছর ঘুরে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর প্রসঙ্গ কেন উঠল তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের এক উপদেষ্টা সম্প্রতি বিদেশ সফরে গিয়ে একটি বাংলাদেশি মিশনে রাষ্ট্রপতির ছবি টাঙানো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতেই সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশি মিশনগুলোতে থাকা রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর নির্দেশ দেয়।

তবে বিষয়টি সব মিশনে একসঙ্গে জানানো হয়নি। সূত্র জানায়, সরাসরি সব মিশনকে নির্দেশ পাঠানো না হয়ে কয়েকজন রাষ্ট্রদূতকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে যেন অন্য মিশনপ্রধানদের এ বিষয়ে অবহিত করেন।

গত শনিবার মধ্যরাত থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর নির্দেশনার খবর ছড়িয়ে পড়ে। রোববার (১৮ আগস্ট) সারাদিনই এটি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে—বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়—এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি।

এদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গা বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের দীর্ঘ বৈঠক শেষে সাংবাদিকরা পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়ামের কাছে রাষ্ট্রপতির ছবি ইস্যুতে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। একইভাবে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শাহ আসিফ রহমানও প্রশ্ন এড়িয়ে যান।

এ বিষয়ে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমিও আপনার মত পত্রিকায় পড়েছি কিন্তু যেহেতু আমি বিদেশি দূতাবাসে কাজ করি না সেহেতু বলতে পারছি না যে আসলে প্রেক্ষিতটা কী।’

সরকারি সিদ্ধান্ত হলে তার লিখিত কাগজপত্র থাকত মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টা পরিষদে এ বিষয়ে আলোচনা হলে বলা যাবে।’

আরেক প্রশ্নে রিজওয়ানা বলেন, ‘এটার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই, সেটা স্পষ্ট। একটা ছবির সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক থাকতে পারে না।’

সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ৮২টি মিশন ও উপমিশন রয়েছে। এরমধ্যে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পরপরই অনেক মিশন থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। নতুন নির্দেশনার আগ পর্যন্ত প্রায় ৭০টি মিশন বিগত সময়ের সব ছবি সরিয়ে ফেলে।

নতুন করে রাষ্ট্রপতির ছবি নামিয়ে ফেলার নির্দেশনার পর এরই মধ্যে বাকি মিশনগুলো থেকেও রাষ্ট্রপতির ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ইউরোপের একটি মিশনে পদায়নরত এক কূটনীতিক জানান, এ মিশনে রাষ্ট্রপতির ছবি ছিল। নতুন নির্দেশনা পাওয়ার পর শনিবার বিকেলে মিশন থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানো হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের চার অনুচ্ছেদে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনসমূহে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ব্যবহারের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এর বাইরে সরকার প্রধানের ছবি ব্যবহার করা নিয়ে কোনো আইন, বিধি বা সাংবিধানিক নির্দেশনা বিগত সরকারের সময়ে হয়নি। তবে ২০০২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রীদের কার্যালয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি কিংবা ছবি টাঙানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

ওই নির্দেশ মোতাবেক বিদেশে বাংলাদেশি মিশনে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের ছবি টাঙানো রীতি চলে আসছে। তবে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছবি টাঙানোর বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেননি। বরং পত্রিকাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন বা অন্য কোনো প্রচারণায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানের ছবি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে সাবেক এক রাষ্ট্রদূত বলেন, রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সরকারি আদেশে রাষ্ট্রপতির ছবি ব্যবহারের নির্দেশনা ছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিশনগুলোতে অফিশিয়াল পোর্ট্রেট সরবরাহ করতো। আর এই পোট্রেট কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচন করে দেওয়া হতো। মিশন বলে কথা না সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলোর জন্য একই ছবি নির্বাচন করা হতো। কেউ চাইলেও রেনডমলি ছবি নির্বাচনের সুযোগ ছিল না। হঠাৎ করে শুধু মিশন থেকে ছবি সরানোর নির্দেশনা হবে, এমনটা হওয়ার কথা না। হলে সরকারি অন্য অফিসেও একই নির্দেশনা হওয়ার কথা।

এদিকে রোববার রাতে প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘সরকারি দপ্তরে পোট্রেট ব্যবহার শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার নিরুৎসাহিত করছে। অলিখিতভাবে জিরো পোট্রেট নীতি বজায় রেখেছে। তারপরও কেউ কেউ সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি নিজ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করেছে। সেগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে এমন কোনো লিখিত নির্দেশনা কোনো দপ্তর কিংবা মিশনকে দেওয়া হয়নি। তারপরও দেখা যাচ্ছে আজ এটা নিয়ে বাজার গরম করে ফেলা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় ঘোষণা করার পর রাজনীতি নিয়ে ঘোঁট পাকানোর সুযোগ কমে আসছে। কাটতি ধরে রাখার জন্য ছোট খাটো অনেক বিষয়কেও এখন তাই পাহাড়সম করে তোলা হচ্ছে।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রপতির ছবি রাখা না রাখা পুরোপুরি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত। এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয় না। নতুন কোনো নিয়ম হয়েছে কিনা-আমার জানা নেই, তবে মন্ত্রিপরিষদের আগের সিদ্ধান্ত ছিল যে কোনো সরকারি অফিসে রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারপ্রধানের ছবি টাঙাতে হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ধরনের নির্দেশনা দিতে পারে কিনা- এমন প্রশ্নে মাহফুজুর রহমান বলেন, বলে না থাকলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বলার কথা না। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত মৌখিক নির্দেশ কেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত