ঢাকা, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন জনবুদ্ধিজীবী

ডুয়া নিউজ- জাতীয়
২০২৫ জুলাই ২৬ ১৮:৩৩:০৪
এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন জনবুদ্ধিজীবী

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ শুধু প্রথাগত বুদ্ধিজীবীই ছিলেন না, বরং গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে গেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ও ১/১১-এর কঠিন সময় পর্যন্ত তিনি ছিলেন এক সাহসী ও নীতি নিষ্ঠকণ্ঠস্বর। তিনি যেকোনো অন্যায়, স্বৈরাচার ও অনাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন স্পষ্ট অবস্থানে। গণতন্ত্রকে তিনি শুধু বিশ্বাস করতেন না, ব্যক্তি জীবনেও তা চর্চা করতেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন একজন ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ বা জনবুদ্ধিজীবী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীপ্রয়াত অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

শনিবার (২৬ জুলাই) জাতীয় প্রেস ক্লাবেরতোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনেএমাজউদ্দীন আহমদ রিসার্চ সেন্টারের উদ্যোগে এ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়

স্মারক বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য অধ্যাপক এম শমশের আলীর অনুপস্থিতিতে স্মারক বক্তব্য রাখেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও এমাজউদ্দীন আহমদ রিসার্চ সেন্টারের আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম।

তিনি বলেন, ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ বা জনবুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্যের বিচারে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের অগ্রজ জনবুদ্ধিজীবী। আট দশকের জীবনপথে তিনি আলো সঞ্চারী সূর্যের মতো পরিভ্রমণ করেছেন সময় ও মান চিত্রজুড়ে। তিনি ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ, জ্ঞানের সমুদ্রতীর্থ, মানুষ গড়ার কারিগর, পুরোধা পুরুষএকজন অসাধারণ সৃষ্টিশীল মনীষা। তিনি জাতীয় চৈতন্যে ভাস্বর, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, অত্যুজ্জ্বল বাতিঘর, বাস্তববাদী, জ্ঞানী ও মর্যাদাবান। ছিলেন একজন পণ্ডিত, দক্ষ প্রশাসক, হৃদয়বান মানুষ, শিক্ষাবিদ, মহানুভব, জ্ঞানতাপস ও সত্য উচ্চারণে সাহসী বাগ্মীপুরুষযিনি জাতির বিবেক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এসব শব্দ কোনো ভক্তের অতিশয় উক্তি নয়; বরং তাঁর জীবনকালের মূল্যায়নে দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এমন কোনো ধাপ নেই যেখানে অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের সাহসী পদচারণাঘটেনিএরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১/১১-এর কঠিনসময়পর্যন্ততাঁরভূমিকাছিলসুদূর প্রসারীতিনিইসেইব্যক্তিযিনিসামরিকশাসনেরকুফলনিয়েপ্রথমসরাসরিবক্তব্যদিয়েছেনদুইনেত্রীগ্রেফতারহওয়ারপরসাহসীবিবৃতিদিয়েছেনযেখানেইঅন্যায়, অনাচারঅত্যাচারদেখেছেন, সেখানেইপ্রতিবাদকরেছেন। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যখনই মানবাধিকারের ব্যত্যয় ঘটেছে, গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে কিংবা জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে, তখনই তিনি প্রতিবাদ ও আন্দোলনে শরিক হয়েছেনদেশনেত্রী অবরুদ্ধ হলে, ট্রাকেরচাকায় গণতন্ত্র পিষ্ট হলে কিংবা নির্বাচন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হলে তিনি সরাসরি প্রতিবাদ করেছেন। তিনি কোনো দল, গোষ্ঠী বা পক্ষের রাজনীতি করেননি; বরংনিজস্বস্বকীয়ধারায়দেশ প্রেম প্রসূতএকজননিরপেক্ষবুদ্ধিজীবীছিলেন, যিনিগণতন্ত্রকেজাতিরজীবন রেখামনেকরতেনএইস্বাতন্ত্র্যথাকাসত্ত্বেওতাঁরবিরুদ্ধেরাজনৈতিকমামলাহয়েছে, বাড়িআক্রান্তহয়েছে, পরিবারঅন্যায়েরশিকারহয়েছেব্যক্তিগত ভাবেতিনিবিব্রতহয়েছেন, তবুওঅবিচল ভাবেধৈর্যসাহসেবৈপরীত্যেরমোকাবিলাকরেছেন

এর আগে স্বাগত বক্তব্যে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বাবার সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন, বুদ্ধিজীবী মহল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণের জগতে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অনন্যসাধারণ, বহুমাত্রিক এবং বিরল প্রতিভাধর এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবন ও কর্ম যেমন ছিল বিস্তৃত, তেমনি মানবিকতায় পরিপূর্ণ। তিনি প্রাঞ্জল, তথ্যনির্ভর এবং মানবিক ভাষায় কথা বলতেন। তাঁর শব্দ ছিল পরিমিত, কিন্তু বক্তব্য স্পষ্ট। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা-ই বলতেন। ছিলেন নির্ভীক এবং বুদ্ধিজীবী সমাজের অগ্রদূত।

তিনি আরও বলেন, যখন বিএনপির কোনো বুদ্ধিজীবী সংগঠন ছিল না, তখন তিনি ৯০-এর দশকে ‘শত নাগরিক’ নামে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন, যাতে বিএনপিকে বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়া যায়। তাঁর নেতৃত্বে গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নানা দিকনির্দেশনা উঠে আসে। তিনি জাতিকে আলোকিত করেছেন এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেনব্যক্তিজীবনে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বেগম সেলিনা আহমদকে বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের পাঁচ সন্তান ও সাত-আটজন নাতি-নাতনি নিয়ে ছিল একটি সুখী পরিবার। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারিবারিক, বিনয়ী ও কোমল হৃদয়ের মানুষ। বিশাল পান্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও কখনো অহংকার করেননি, কাউকে ছোট করেননি। সবাইকে বন্ধু ও সহকর্মী হিসেবে দেখতেন, ছোটদের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন এবং তাঁদের কল্যাণকামী ছিলেন। আমি সবার কাছে বাবার জন্য দোয়া চাইআল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাত নসিব করেন।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েররাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানমেজবাহ উল-আজম সওদাগর। অনুষ্ঠানের শুরুতে মাইলস্টোনট্র্যাজেডি স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন এবং উপস্থিত ছিলেন কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. সফিকুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদেরডিন এবং রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. এনায়েতউল্লাহপাটোয়ারী, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ জি এম নিয়াজ উদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েররাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক স ম আলী রেজা, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরপলিটিক্যালস্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর নগরবিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদেরডিন এবং সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামছুল আলম সেলিম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েররাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. নঈমআক্তার সিদ্দিক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর ফারুক এবং শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান।

এ ছাড়াও, এমাজউদ্দীন আহমদ রিসার্চ সেন্টারের অন্যতম উদ্যোক্তা বিশিষ্ট শিল্পপতি ও লেখক আবুল কাসেম হায়দার, এমাজউদ্দীন আহমদের ছেলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক জিয়া আহমদ, নাতনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বুশরা মাহজাবীন, আরেক নাতনি পিএস-এনগেজ এর সিনিয়রঅ্যাডভাইজারশাফকাতসিদ্দিকা-সহ প্রমুখ বক্তব্য দেন।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত