ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

শেয়ারবাজারের ১৬ ঝুঁকিপূর্ণ সাধারণ বীমা কোম্পানিতে বিশেষ নিরীক্ষা

ডুয়া নিউজ- অর্থনীতি
২০২৫ জুলাই ০৩ ০৬:৫৫:৩২
শেয়ারবাজারের ১৬ ঝুঁকিপূর্ণ সাধারণ বীমা কোম্পানিতে বিশেষ নিরীক্ষা

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ১৬টি সাধারণ বীমা কোম্পানিকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ নিরীক্ষা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো খাতটিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা।

আইডিআরএ'র চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম বুধবার (০২ জুলাই) তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে জানান, “সুশাসন, দাবি নিষ্পত্তি এবং সম্পদ শ্রেণিকরণের দিক থেকে আমরা সম্প্রতি আমাদের মূল্যায়নে এই বীমা কোম্পানিগুলোকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পেয়েছি।” তিনি আরও বলেন, গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাত মাস পর দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি দুর্বল পারফর্মারদের সাথে কাজ করছেন এবং সংকট মোকাবেলায় নতুন নিয়মকানুন তৈরি করা হয়েছে।

এই বিশেষ নিরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো, কেন বীমা কোম্পানিগুলো সময়মতো পলিসিহোল্ডারদের দাবি নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হচ্ছে, কেন প্রিমিয়াম সংগ্রহে সমস্যা হচ্ছে, পলিসি ল্যাপস হওয়ার কারণ এবং তাদের সম্পদের বর্তমান অবস্থা কী, তা উদঘাটন করা। ড. আলম আরও জানান, নিরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হবে এবং যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আইডিআরএ'র একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহের শুরুতেই ১৬টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি পাঠানো হবে। পৃথক নিরীক্ষা সংস্থাগুলোকে আর্থিক নিরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে এবং তাদের ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। নিরীক্ষার শর্তাবলীতে যাচাই করা হবে যে, এই সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো বীমা আইন ২০১০ মেনে চলছে কিনা।

এছাড়া, কোম্পানিগুলোর ২০২৩ সালের আর্থিক বিবরণী, প্রিমিয়াম সংগ্রহ, জমা, ফেরত বা পলিসি বাতিল, পুনঃবীমা, ডাটাবেসের নির্ভুলতা এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয় সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রক নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়েছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হবে।

উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর তালিকায় রয়েছে: ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশ, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স, দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স, ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স, মার্কেন্টাইল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স, রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স, সিকদার ইন্স্যুরেন্স, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স এবং নিটল ইন্স্যুরেন্স।

উল্লেখ্য, দেশে মোট ৮২টি বীমা কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে ৩৬টি জীবন বীমা এবং ৪৬টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি। এদের মধ্যে ৫৮টি জীবন ও সাধারণ বীমা কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে।

ড. আসলাম আলম দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের বীমা খাত অব্যবস্থাপনা, তহবিল আত্মসাৎ এবং দুর্বল নজরদারিতে জর্জরিত। অনেক বীমা কোম্পানি সময়মতো পলিসিহোল্ডারদের দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় এই খাত চরম অবিশ্বাসের মুখোমুখি হচ্ছে। ২০১০ সালের আইন অনুযায়ী, পলিসি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নথি জমা দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে দাবি নিষ্পত্তি করতে হয়। বর্তমানে জীবন বীমা খাতে ৪৫ শতাংশ এবং সাধারণ বীমা খাতে প্রায় ৪৭ শতাংশ দাবি অপরিশোধিত রয়েছে। আইডিআরএ'র তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ বছরে ৫.৪ মিলিয়নেরও বেশি পলিসি ল্যাপস হয়েছে এবং প্রায় ১.১ মিলিয়ন পলিসিহোল্ডার বর্তমানে তাদের বকেয়া আদায় করতে পারছেন না।

এই প্রেক্ষাপটে আইডিআরএ বীমা খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আইন ও বিধিমালা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে। সরকার 'বীমা সমাধান অধ্যাদেশ ২০২৫' (Insurance Resolution Ordinance 2025)-এর একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে, যা ব্যাংক সমাধানের মতো। এটি গত সপ্তাহে জনমত ও অংশীজনদের মতামতের জন্য প্রকাশিত হয়েছে। এই নতুন অধ্যাদেশের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো পলিসিহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা করা, বিশেষ করে সময়মতো দাবি নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা।

আইডিআএ চেয়ারম্যান বলেন, নতুন অধ্যাদেশটি সমস্যাগ্রস্ত বীমা কোম্পানিগুলোর পুনর্গঠন, মালিকানা পরিবর্তন, একীভূতকরণ বা বিলুপ্তির জন্য আইনি সুযোগ তৈরি করবে। নতুন অধ্যাদেশ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আর্থিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত বীমা কোম্পানিগুলোকে দেউলিয়া ঘোষণা করার ব্যাপক ক্ষমতা দেবে। প্রয়োজনে, পলিসিহোল্ডারদের বকেয়া পরিশোধের জন্য পরিচালকদের ব্যক্তিগত সম্পদও বিলুপ্ত করা যাবে।

বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ ও অপসারণ সংক্রান্ত বিধিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চলেছে। আইডিআরএ প্রধান জানান, এই উদ্যোগটি মূলত বীমা খাতে যোগ্য শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের সংকট মোকাবেলার জন্য নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৮২টি বীমা কোম্পানির মধ্যে ১৯টি এক থেকে তিন বছর ধরে সিইও ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। কোম্পানিগুলো দাবি করছে, তারা শীর্ষ পদের জন্য যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না।

ড.আসলাম আলম আরও বলেন, বিদ্যমান নিয়মগুলো প্রশাসক নিয়োগ এবং এই কোম্পানিগুলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বীমা খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সুশাসন নিশ্চিত না হলে মানুষের আস্থা বাড়বে না। নতুন আইন ও বিধিমালা মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত