ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২ পৌষ ১৪৩২

দিন দিন বাড়ছে এনার্জিপ্যাকের লোকসান, বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ

২০২৫ নভেম্বর ২৪ ১৭:২৭:১০

দিন দিন বাড়ছে এনার্জিপ্যাকের লোকসান, বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ

নিজস্ব প্রতিবেদপক: এক সময়ে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরিচিত নাম এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন পিএলসি এখন চরম আর্থিক সংকটের কবলে। টানা লোকসানের কারণে কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত আয় এখন ঋণাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে।

২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে কোম্পানিটির মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০৬ কোটি টাকা, যা তাদের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে দিয়েছে। ফলস্বরূপ, তাদের পুঞ্জীভূত আয় ৫৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ঋণাত্মক হয়েছে।

চলতি অর্থবছর (FY26)-এর প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এই সময়ে আয় ৬৫ শতাংশ কমে ৬০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা হয়েছে এবং ত্রৈমাসিকে ৫৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা নিট লোকসান হয়েছে।

কোম্পানিটির এমন দুঃসংবাদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এও সাথে সাথেই প্রভাব ফেলে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে যাওয়ায় রবিবার (২৩ নভেম্বর) শেয়ারের দাম ৭.৯৫ শতাংশ কমে ১৬.২০ টাকায় দিন শেষ করেছে। বর্তমান এই শেয়ার মূল্য প্রমাণ করে যে, শেয়ারহোল্ডারদের মূল্য অনেক কমে গেছে, যা তাদের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও মূল্যের তুলনায় অনেকটাই নিচে।

২০২১ সালে কোম্পানিটি ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। সে সময় যোগ্য বিনিয়োগকারীরা ৩৫ টাকায় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ৩১ টাকায় শেয়ার পেয়েছিলেন। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, তালিকাভুক্তির পর থেকে শেয়ারটি অর্ধেকেরও বেশি মূল্য হারিয়েছে।

সেপ্টেম্বর ২০২৫ শেষে পুনঃমূল্যায়নসহ কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ২৯ টাকা ৮৬ পয়সায়, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৯ শতাংশ কম।

এনার্জিপ্যাক তাদের মূল্য সংবেদনশীল তথ্যে লোকসানের প্রধান কারণ হিসেবে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় অর্থায়ন খরচ (ফাইন্যান্স চার্জ) তীব্রভাবে বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করেছে। কোম্পানি জানিয়েছে, শিল্পখাতে সামগ্রিক আয় হ্রাস, অর্থায়ন খরচ বৃদ্ধি এবং পুরোনো ঋণের দায়বদ্ধতার কারণেই পুঞ্জীভূত আয় সাময়িকভাবে ঋণাত্মক হয়েছে এবং এনএভি কমেছে।

তবে, কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আশার আলো দেখিয়েছে। তারা জানিয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১০ বছর মেয়াদি পুনর্গঠিত অর্থায়ন সুবিধা পেয়েছে, যার মধ্যে দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে। এই সুবিধা ঋণ পরিশোধের চাপ কমাবে, যা ভবিষ্যতে পুঞ্জীভূত আয় পুনরুদ্ধার এবং এনএভি বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।

অনিয়মিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট মেয়াদি ঋণ ছিল ১,৩২৭ কোটি টাকা, যার প্রধান ঋণদাতা হলো মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ইস্টার্ন ব্যাংক।

তারল্য ও পরিচালন চাহিদা সামলাতে পরিচালনা পর্ষদ সম্পত্তি বিক্রি করছে। বোর্ড সম্প্রতি তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ১৬.৫০ ডেসিমেল জমি সহ-প্রতিষ্ঠান এনার্জিপ্যাক ফ্যাশন লিমিটেড-এর কাছে প্রায় ৩৩ কোটি টাকায় বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে আরও ৫৯৭ ডেসিমেল জমি ১৯ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছিল।

ঐতিহাসিক পারফরম্যান্স পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোম্পানির আয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে। ২০২২ অর্থবছরে আয় ২,০৩৩ কোটি টাকায় পৌঁছালেও ২০২৩ অর্থবছরে তা কমে ৮০০ কোটি টাকা হয়, ২০২৪ অর্থবছরে ২৮০ কোটি টাকায় নেমে আসে এবং ২০২৫ অর্থবছরে সামান্য বেড়ে ৩০৮ কোটি টাকা হয়।

মুনাফাও কমে গেছে; ২০২১ অর্থবছরে ৩৯ কোটি টাকা এবং ২০২২ অর্থবছরে ৯.৭০ কোটি টাকা মুনাফার পর, ২০২৩ অর্থবছরে ৪৫ কোটি টাকা এবং ২০২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে ১০৫ কোটি টাকা লোকসানে পরিণত হয়েছে।

বর্তমানে জি-গ্যাস ব্র্যান্ডের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), নির্মাণ সামগ্রী, জেএসি (JAC) ব্র্যান্ডের মোটর গাড়ি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ থেকে এনার্জিপ্যাকের আয় আসে। তবে, রাজস্ব কমার মূল কারণ কৌশলগত পুনর্গঠন।

২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত কোম্পানিটি তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র – এনার্জিপ্যাক পাওয়ার ভেঞ্চার লিমিটেড, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার ভেঞ্চার চট্টগ্রাম লিমিটেড ও ইপিভি ঠাকুরগাঁও লিমিটেড – থেকে বড় অঙ্কের আয় করত, যা পরে কোম্পানির পরিচালকদের মালিকানাধীন সোনারগাঁও লেদার অ্যান্ড রেক্সিন ক্লথ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এ হস্তান্তর করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, এই হস্তান্তরই আয় কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। তিনি বলেন, "সরকারের চাহিদা কমার কারণে কোম্পানির পুরোনো মূল ব্যবসা ট্রান্সফরমার অ্যাসেম্বলিং ও বিক্রি এখন কমে গেছে। এর পাশাপাশি, বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরঞ্জাম বিক্রিতেও বড় ক্ষতি হয়েছে।"

ফলস্বরূপ, এনার্জিপ্যাক ২০২৪ অর্থবছরের জন্য কোনো লভ্যাংশ দেয়নি এবং ২০২৫ অর্থবছরের জন্য খুচরা শেয়ারহোল্ডারদের জন্য মাত্র ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ সুপারিশ করেছে, যা নগদ প্রবাহের সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরে।

উল্লেখ্য, ২০২৩ অর্থবছরে ঘোষিত ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশের ন্যূনতম ৮০ শতাংশ বিতরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর ডিএসই এনার্জিপ্যাক পাওয়ারকে 'বি' ক্যাটাগরি থেকে 'জেড' ক্যাটাগরিতে নামিয়েছিল। ২৯ সেপ্টেম্বর লভ্যাংশ বিতরণের পর কোম্পানিটিকে আবার 'বি' ক্যাটাগরিতে ফিরিয়ে আনা হয়। কোম্পানির মোট শেয়ারের মধ্যে ৫৪.১৪ শতাংশ স্পন্সর ও পরিচালকদের হাতে, ১৬.৫১ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে এবং বাকি ২৯.৩৫ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে।

এমজে/

শেয়ারবাজারের বিশ্লেষণ ও ইনসাইড স্টোরি পেতে আমাদের পেজ ফলো করুন।

পাঠকের মতামত:

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

সর্বোচ্চ পঠিত