ঢাকা, বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২
আজ বিশ্ব সুনামি সচেতনতা দিবস
ইনজামামুল হক পার্থ
রিপোর্টার
ইনজামামুল হক পার্থ: আজ ৫ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হচ্ছে ‘বিশ্ব সুনামি সচেতনতা দিবস’। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই দিনটিকে সুনামি সচেতনতা বাড়ানোর জন্য নির্ধারণ করে। দিবসটির মাধ্যমে দেশ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও নাগরিক সমাজকে সুনামি ঝুঁকি কমানো, প্রস্তুতি ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উদ্ভাবনী পদ্ধতি ভাগাভাগি করার আহ্বান জানানো হয়।
‘সুনামি’ শব্দটি এসেছে জাপানি ‘tsu’ (বন্দর) এবং ‘nami’ (ঢেউ) থেকে। এটি হলো বিশাল ঢেউয়ের এক সিরিজ, যা সাধারণত সমুদ্রের তলদেশে বা কাছে সংঘটিত ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ডুবোজাহাজ, ভূমিধস বা উপকূলীয় শিলা পতনের কারণে সৃষ্টি হয়। বৃহৎ গ্রহাণু সমুদ্রে আঘাত হানলেও সুনামি তৈরি হতে পারে। সুনামির ঢেউ সাধারণত পানির দেয়ালের মতো দেখতে এবং উপকূলে আঘাত করে।
বিশ্ব সুনামি সচেতনতা দিবস উদযাপনের প্রচলন জাপান থেকে এসেছে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশটি সুনামির আগাম সতর্কতা, জনসচেতনতা এবং দুর্যোগের পর পুনর্গঠন ও ক্ষতি হ্রাসে দক্ষতা অর্জন করেছে। জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস সংস্থা (UNDRR) আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই দিবস উদযাপনকে সহজ করে।
গত ১০০ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন সুনামি দুর্ঘটনায় ২ লাখ ৬০ হাজার এরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গড়ে প্রতি দুর্যোগে মারা গেছে ৪ হাজার ৬০০ জন, যা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য। সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট সুনামিতে।
বাংলাদেশ:
ভূতাত্ত্বিক কারণে বঙ্গোপসাগরের নিকটে থাকা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলি সুনামির ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূ-তাপমাত্রা ও প্লেট সক্রিয়তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ উপকূল তিন ভাগে বিভক্ত করেছে:
- চট্টগ্রাম-টেকনাফ উপকূল (ঝুঁকিপূর্ণ জোন-I): সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। (ভারত ও বার্মিজ প্লেটের সীমানার খুব কাছে অবস্থিত)
- সুন্দরবন-বরিশাল উপকূল (ঝুঁকিপূর্ণ জোন-II): মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ। (দীর্ঘস্থায়ী ডেল্টার কারণে ছোট সুনামিতেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে)
- বরিশাল-সন্দ্বীপ উপকূল (ঝুঁকিপূর্ণ জোন-III): তুলনামূলক কম ঝুঁকি। (অনেক ছোট দ্বীপ-দ্বীপাকৃতি এবং শ্যাওল থাকায় ঢেউ কিছুটা ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনা থাকে)
বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য কোনো বড় সুনামি ঘটেনি; তবে ২০০৪ সালের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সুনামি ঢেউ বরিশালের উপকূলে নৌকা উল্টে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। এই ঘটনার পর সরকার সুনামি ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্তি বাড়ায়। (জনগণ মূলত ঘূর্ণিঝড়-সুনামির অভিজ্ঞতাই বেশি হওয়ায় তীব্র সুনামির আশঙ্কাকে অনেকটা অগ্রাহ্য করে চলেছে।)
সরকার ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক আইনি ও কাঠামোগত প্রস্তুতি নিয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ ও ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার অন ডিজাস্টার’ কার্যক্রমের অধীনে ঝুঁকি হ্রাস ও প্রস্তুতির দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিষদ, জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি ও সমন্বয় কমিটি (NDRCC) প্রভৃতি রয়েছে এবং জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করা আছে। সতর্কবার্তা ছাড়ার জন্য আবহাওয়া অধিদপ্তরকে জাতীয় “সুনামি সতর্কতা কেন্দ্র” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর (BMD) ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও সতর্কতাসংক্রান্ত ইনফ্রাস্ট্রাকচারে বিনিয়োগ করছে। চট্টগ্রামে ১৯৫৪ সাল থেকে একটি ভূমিকম্প স্টেশন রয়েছে, বর্তমানে আরো তিনটি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া, BMD প্যাসিফিক সুনামি সতর্কতা কেন্দ্র (PTWC) ও জাপান মেটিওরোলজিক্যাল এজেন্সির (JMA) সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং তাদের গ্লোবাল টেলিকম নেটওয়ার্ক (GTS) ব্যবহার করে সুনামি পরামর্শ পাওয়া হয়। সোনালী বেতারে বিস্তৃত সাইক্লোন সতর্কতা নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সুনামি সতর্কবার্তা জনসাধারণকে পৌঁছে দেওয়া হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা কার্যক্রম
উপকূলীয় স্কুলগুলিতে সুনামি প্রস্তুতি বিষয়ক প্রশিক্ষণ জোরদার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে UNDP বাংলাদেশ ও বাঙ্গলা সরকার প্রকল্পের উদ্যোগে কক্সবাজারের ১৬টি স্কুলের শিক্ষক ও পরিচালকদের দুইদিনের প্রশিক্ষণ ও মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এতে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা, জরুরী অব্যাহত রাখার জায়গা চিহ্নিতকরণ ও আহত সুরক্ষাসহ সুনামি মোকাবিলার বিভিন্ন দিক শেখানো হয়। প্রশিক্ষকরা জানিয়েছেন যে এই মহড়ার মূল উদ্দেশ্য হল বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুনামি ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা এবং সুরক্ষিত ইভ্যাকুয়েশন পরিকল্পনা গঠন ও অভ্যাস গড়ে তোলা। ভবিষ্যতে এই সমস্ত প্রস্তুতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী স্কুলগুলির মধ্যে “প্রস্তুতিশীল বিদ্যালয়” হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব নির্বাচনের প্রতিযোগিতাও করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ভবিষ্যতে করণীয়
প্রশমন ব্যবস্থা ও বিনিয়োগ: সুনামি প্রস্তুতিতে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা, ইনভ্যাকুয়েশন ম্যাপিং, শিক্ষালব্ধি এবং নিয়মিত মহড়া জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
নিয়মিত সচেতনতা ও মহড়া: যেহেতু সুনামি দুর্লভ কিন্তু মারাত্মক ঝুঁকি, সরকারি-বেসরকারি স্তরে চলমান প্রচারাভিযান এবং মহড়া চালিয়ে ঝুঁকির স্মরণ তাজা রাখতে হবে।
স্থানীয় অংশগ্রহণ ও শিক্ষা: UNESCO-IOC ‘Tsunami Ready’ প্রয়াসের মতো গ্রাম বা কমিউনিটি স্তরে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে; যেমন ভারতের ওড়িশায় স্বেচ্ছাসেবীরা নিয়মিত শিশুদেরকে সুনামি ইভ্যাকুয়েশন রুট শেখায়, যাতে প্রত্যেক শিশিই জরুরি অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয় পথ জানে। বাংলাদেশেও এরকম প্রক্রিয়া চালু করলে উপকূলীয় জনগণ প্রস্তুত থাকতে পারবে।
বিশ্ব সুনামি সচেতনতা দিবসে ২০২৫ সালের স্লোগান “সুনামির জন্য প্রস্তুত থাকুন: সচেতনতায় বিনিয়োগ করুন” বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক। এখানে বর্ণিত ঝুঁকি ও প্রস্তুতি ব্যবস্থা মূল্যায়ন করলে বোঝা যায় যে, ইতোমধ্যে ঝড়-ভরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রস্তুতি শক্তিশালী হলেও সুনামি ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্কতা বৃদ্ধিতে আরও কাজ প্রয়োজন। তার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা, প্রযুক্তি ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিতে হবে।
পরিশেষে, বাংলাদেশকে সুনামি ঝুঁকি থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ হতে হলে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও ও স্থানীয় জনগণ সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। উপকূলভূক্ত নাগরিকদের ভূমিকম্প বা সমুদ্রের অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করলে উচ্চভূমিতে সরিয়ে নেওয়ার মতো ব্যবস্থা জানতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত মহড়া ও দুর্যোগ শিক্ষা চালিয়ে যেতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রস্তর বৃদ্ধির সুযোগ থাকায় সুনামি ঝুঁকিও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে; তাই অবকাঠামো উন্নয়ন, সচেতনতা ও প্রস্তুতিতে ধারাবাহিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করাই নিরাপত্তার পথে আসল চাবিকাঠি।
ইএইচপি
পাঠকের মতামত:
সর্বোচ্চ পঠিত
- ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ফাইনাল: কবে, কখন-যেভাবে দেখবেন লাইভ
- ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া: খেলাটি মোবাইলে সরাসরি(LIVE) দেখুন
- ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া: খেলাটি ফ্রিতে সরাসরি(LIVE) দেখুন
- পাকিস্তান বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা: খেলাটি সরাসরি(LIVE) দেখবেন যেভাবে
- ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে ৯৫ কোম্পানি, দেখুন এক নজরে
- আজ বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২য় টি-টোয়েন্টি: যেভাবে দেখবেন লাইভ (LIVE)
- ডিএসই’র দুই ব্রোকারেজের ট্রেডিং লাইসেন্স বাতিল
- ইপিএস প্রকাশ করেছে ৬৮ কোম্পানি, দেখুন এক নজরে
- মার্জিন রুল থেকে মিউচুয়াল ফান্ড—সবখানেই আসছে বড় পরিবর্তন
- বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩য় টি-টোয়েন্টি: খেলাটি সরাসরি(LIVE) দেখবেন যেভাবে
- ইপিএস প্রকাশ করেছে ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক
- ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া: খেলাটি মোবাইলে সরাসরি দেখুন (LIVE)
- ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ
- ‘নো ডিভিডেন্ড’ ঘোষণার পর শেয়ার দামে রেকর্ড দৌড়
- ইপিএস প্রকাশ করেছে বিএটিবিসি